পদ্মা সেতু- কাজ হয়েছে ১৮%, ব্যয় বাড়ছে ৮ হাজার কোটি টাকা by আনোয়ার হোসেন

মাটি পরীক্ষার জন্য মাঝ নদীতে
এ আয়োজন । ছবি: জাহিদুল করিম
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ১৮ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এখন এর ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। তবে অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় এর ওপর দিয়ে শুরু থেকেই রেল চালু করার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সেতু বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী অক্টোবরে শুরু হবে সেতুর মূল পাইলিংয়ের কাজ। আগামী বছর মে মাসে খুঁটির ওপর সেতুর স্প্যান বসানো শুরু হবে। আর সেতুটি চালু হবে ২০১৮ সালে। এখন চলছে মূল সেতুর পরীক্ষামূলক পাইলিং। পদ্মা সেতুর দুই পারে ১৬০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। এর জন্য প্রয়োজন প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এখনো এই অর্থের সংস্থান হয়নি। সরকার চীনা অর্থায়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে।
পদ্মা সেতুর কাজ মোটাদাগে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মূল সেতু, নদীশাসন, দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো (সার্ভিস এলাকা) নির্মাণ। এর বাইরে আছে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন। এ পর্যন্ত যে অগ্রগতি হয়েছে, এর বেশির ভাগজুড়েই রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন, সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো।
এর মধ্যে মূল সেতুর জন্য চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনকে (এমবিইসি) ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয় গত বছর জুনে। নিয়োগের পরই মূল চুক্তির ১৫ শতাংশ অর্থ দেওয়া হয় ঠিকাদারকে। গত বছরের নভেম্বরে ৮ হাজার ৭০৭ কোটি টাকায় নদীশাসনের কাজ পায় চীনেরই সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ পায় বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড। চুক্তি হয় ২০১৩ সালের শেষের দিকে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ যেসব মালামাল বা যন্ত্র ব্যবহৃত হবে, প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকের সেবা নেওয়া হবে—এর ২৫ শতাংশ দেশের ভেতর থেকে জোগান দেওয়া হবে।
সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে হলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, সব যন্ত্রপাতি ও মালামাল সময়মতো পৌঁছাতে হবে। আর নকশায় যে গভীরতায় পাইলিং করার কথা বলা হয়েছে, তা মিলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে প্রকল্পের কাজও পিছিয়ে যাবে। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা-অনিয়ম হলেও কাজে গতি কমে যাবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ চীনা কোম্পানি। কারণ, চীনা কোম্পানির বিরুদ্ধে সময়ক্ষেপণ ও নিম্নমানের কাজ করার উদাহরণ আছে বাংলাদেশেই।
মাওয়া প্রান্তে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ
এগিয়ে চলেছে। ছবি: জাহিদুল করিম
গত শুক্রবার সরেজমিনে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা ও মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ দেখা গেছে। মাওয়া ও জাজিরার মধ্যেই হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন, নিচ দিয়ে যাবে রেল।
মাওয়া চৌরাস্তা বরাবর দিয়ে সেতুটি হবে। এ জন্য সেখান থেকে ফেরিঘাট সরিয়ে আড়াই কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
আগের ফেরিঘাটের দুটি স্থানে ৫০০ ও ২৫০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি এবং ৫০ টনের কয়েকটি ক্রেন ভাসমান বার্জে বসিয়ে পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ চলছে। মাওয়ার কোমারভোগে নদীর পারে বিশাল নির্মাণ মাঠে মূল সেতুর মালামাল রাখা হয়েছে। যন্ত্রপাতি ও ঠিকাদারি কোম্পানির লোকজনের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে বড় বড় শেড। দুটি জেটি তৈরি করা হয়েছে নদী থেকে মাঠে মালামাল তোলার জন্য।
সেতু বিভাগের হিসাবে গত এপ্রিল পর্যন্ত মূল সেতুর কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭.৮৩ শতাংশ।
নদীশাসনের কাজ একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। বার্জে করে বালুভর্তি বস্তা নদীতে ফেলতে দেখা গেছে। তিনটি ড্রেজার, একটি বহুমুখী কাজের জাহাজ, একটি টাগবোট, তিনটি অ্যাংকর বোট, ২৫টি কনটেইনার ও প্রায় ৫০০ ড্রেজিং পাইপ প্রকল্প এলাকায় বসানো হয়েছে। নদীর দুই তীরে প্রায় ১৪ কিলোমিটারজুড়ে নদীশাসন করা হবে।
মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে ১৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৪২ শতাংশ। অবকাঠামো নির্মাণ এগিয়েছে ৩৩ শতাংশ। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে অফিস ভবন, ল্যাবরেটরি, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুপ্লেক্স ভবনের মোটেল, ওভারহেড পানির ট্যাংক, বিদ্যুতের সাবস্টেশন, গার্ডদের বাসস্থান, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তুতিপর্বে বেশি সময় ব্যয় হয়। কাজ শুরু হয়েছে। আগামী বছরই মূল সেতু দৃশ্যমান করা যাবে।
ব্যয় ও সময় বাড়ছে: চলতি মাসের শুরুতে পদ্মা সেতুর জন্য ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সেতু বিভাগ। এতে প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।
বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতার পর ২০১২ সালে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এর আগে ২০১১ সালে একবার প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে। পদ্মা সেতুর মূল প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছিল ২০০৭ সালে। তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, আগের ব্যয় ছিল প্রাক্কলন। ঠিকাদার নিয়োগ তখনো হয়নি। এখন যে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে, সেটাই প্রকৃত। আর এ সময়ে কাজও কিছু বেড়েছে।
শুরুতে রেল চলাচলে অনিশ্চয়তা: অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় শুরু থেকেই পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চলাচল নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। রেলওয়ে সূত্র জানায়, চীন সরকারের কাছে রেললাইন নির্মাণে অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে সরকার।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, চীনেরই কোম্পানি চায়না রেলওয়ে গ্রুপের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। এই কোম্পানিটি টঙ্গী-ভৈরববাজার পথে নতুন একটি রেললাইন নির্মাণের কাজ করছে। মূল পদ্মা সেতুর কাজ পাওয়া চায়না মেজর ব্রিজ রেলওয়ে গ্রুপেরই একটি প্রতিষ্ঠান।
পদ্মার দুই পারে ১৬০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। আর ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত ৭৭ দশমিক ৬ কিলোমিটার। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্ম্যাককে দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই ও রেলপথ ঠিক করে জমি চিহ্নিতও করা হয়েছে।
জানতে চাইলে রেলের এই প্রকল্পের পরিচালক সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার প্রথম দিন থেকেই রেল চালুর বিষয়টি অগ্রাধিকারে রেখেছে। তাঁর আশা, চীনের অর্থ পাওয়া যাবে এবং আগামী বছরই কাজ শুরু করা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.