এই বাহাসের শেষ কোথায়? by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তার যে টান সেটা নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন নেই। সে চেতনাকে সমুন্নত রাখার মিছিলে তিনি অগ্রসেনানি। লেখক হিসেবে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা তার। জড়িয়ে আছেন শিক্ষকতার মহান পেশায়। যে পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করা হয় মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। সে কারিগরকেই ধ্বংসযজ্ঞের নায়ক বললেন এক জনপ্রতিনিধি। যিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ দল থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিল উত্থাপন করে যিনি দেশজুড়ে আলোচিতও হয়েছিলেন।
জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বনাম আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী কয়েস- ধীরে ধীরে যেন এমন যুদ্ধেরই বাতাবরণ বইতে শুরু করেছে। যুদ্ধের দামামা প্রথম বেজে উঠে মাহমুদ-উস সামাদের এক বক্তব্য থেকে। ৯ই মে নিজের নির্বাচনী এলাকা ফেঞ্চুগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালকে ষড়যন্ত্রকারী চিহ্নিত করে তিনি মন্তব্য করেন ক্ষমতা থাকলে তিনি জাফর ইকবালকে চাবুক দিয়ে পেটাতেন। হাওয়ায় হাওয়ায় সে খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ঝড় উঠতে থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। চমকে যান সবাই। একই আদর্শের ছায়ায় কেন এমন বিরুদ্ধ বাতাস।
জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে মাহমুদ- উস সামাদের অসন্তোষ তার ‘সিলেটবিদ্বেষী’ মনোভাবের কারণে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ অভিযোগ করেন জাফর ইকবালের কারণেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারে না। তাদের আটকাতে নানা আইনকানুন তৈরি করে নেন জাফর ইকবাল। ‘সিলেটবিদ্বেষী’ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বেশ পুরনো। তার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটের শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোণঠাসা। শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকেই মনে মনে এসব বিশ্বাস করলেও এতদিন মুখ ফুটে বলেননি। মাহমুদ-উস সামাদের এ বক্তব্য তারা ভালোই লুফে নিয়েছেন। হয়তো এ কারণে নিজের পেছনে ভালোই সমর্থন পেতেন মাহমুদ-উস সামাদ। তবে বেকায়দায় পড়ে গেছেন ‘চাবুক দিয়ে পেটানো’র খায়েশ জানিয়ে। যারা জাফর ইকবালকে পছন্দ করেন না তারাও মানতে পারেননি এমন উদ্ধত কথা।
‘সিলেটবিদ্বেষী’ হিসেবে জাফর ইকবালের গায়ে অনেক দিন থেকে একটি তকমা লাগানো থাকলেও যুক্তি এমনটি বলছে না। যুক্তির বিচারে জাফর ইকবালের ‘সিলেটবিদ্বেষী’ হওয়ার কোন কারণই নেই। তার জন্ম এই সিলেটেই। এখনকার সিলেট নগরীর ব্যস্ততম এলাকা মিরাবাজারে তার শৈশব কেটেছে। বাল্যশিক্ষাও এখানে। তার স্ত্রী ড. ইয়াসমীন হকের রক্তেও রয়েছে সিলেটের উত্তরাধিকার। ইয়াসমীন হকের জন্ম সিলেটে না হলেও তার নানাবাড়ি এখানেই। সব মিলিয়ে জাফর ইকবালের ঘরজুড়ে সিলেটের মাটির ঘ্রাণ। আর তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসী জীবনের মোহমায়া ছেড়ে তিনি শিক্ষক হিসেবে ফিরে এসেছেন তার জন্মের শহর সিলেটেই।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাদের গায়ে জ্বালা ধরায় জাফর ইকবালের এতদিনের প্রতিপক্ষ ছিলেন তারাই। তবে এবার একই চেতনার হাওয়া গায়ে মাখা মাহমুদ-উস সামাদ যখন জাফর ইকবালের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন তখন তা ঝড়ের বিষয়ই। শুধু ‘সিলেটবিরোধিতা’ নয় জাফর ইকবালের আদর্শও যে তার পছন্দ নয় তাও স্পষ্ট করেন মাহমুদ-উস সামাদ। জাফর ইকবাল প্রসঙ্গে বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এই লেফটিস্টরা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।’
মাহমুদ-উস সামাদের এমন বক্তব্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠে আকাশ মাধ্যমে। ফেসবুকে, ব্লগে মাহমুদ সামাদের বিরুদ্ধে সরব হতে থাকেন অনেকেই। দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ ফেসবুকে তার জীবনের শেষ স্ট্যাটাসেও মাহমুদ-উস সামাদের সমালোচনায় মুখর হন। তিনি লিখেন, ‘মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোন দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা এদের নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে! কলিকালের শিক্ষা একেই বলে!’
উদ্ধত বক্তব্যের কারণে মাহমুদ- উস সামাদকে শাবিতে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদের এমন ঝড়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যান মাহমুদ-উস সামাদ। কুলুপ আঁটেন মুখে। তবে সুযোগ আসে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের পরের এক ঘটনায়। অনন্ত বিজয় হত্যার প্রতিবাদে পরদিন ১৩ই মে শাবিতে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে জাফর ইকবাল সরকারের সমালোচনা করেন। প্রতিবাদ জানান, প্রধানমন্ত্রী তনয় সজীব ওয়াজেদের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের। তিনি অভিযোগ করেন, সজীব ওয়াজেদের জয়ের মন্তব্যেই মৌলবাদীরা  উৎসাহিত হচ্ছে।
জাফর ইকবালের ‘জয়বিরোধী’ এমন মন্তব্যকে কাজে লাগাতে চান মাহমুদ-উস সামাদ। জয়কে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে শনিবার দুপুরে দক্ষিণ সুরমা থেকে একটি মিছিল বের হয়। সে মিছিলে স্লোগান উঠে জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে। মিছিল শেষে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়। আর এ মিছিল- সমাবেশের নেপথ্য কারিগর ছিলেন মাহমুদ-উস সামাদই।
জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের এমন মিছিল আরও একদফা সমালোচনার রস যোগায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মিছিলে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদউদ্দিন আহমদের উপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত করে ফেসবুকে জনৈক সৈয়দ হক লিখেন, ‘আমি বিস্ময়ে হতবাক সেই মিছিলে দেখি আমার প্রিয় কিছু মিছিলের মুখ আসাদ ভাই, নিজাম ভাই, মফুর ভাইসহ আরও অনেকে।...আসাদ ভাই ফেসবুকে নিজে স্ট্যাটাসে সেই মিছিলের ছবি দিয়ে বলেছেন কিছু। আমি সম্রাট সিজারের মতো অস্ফুট একটি বেদনা শুধু বলেছি, ‘ব্রুটাস তুমিও’।
আকাশ মাধ্যমে বিরুদ্ধ বাতাস বইতে থাকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিরুদ্ধেও। এমনকি যে চেতনায় জাফর ইকবাল সব সময় উচ্চকণ্ঠ তাকে মুক্তিযুদ্ধের সে চেতনারই বিরুদ্ধ স্রোতে ঠেলে দিচ্ছেন কেউ কেউ।
একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে মাসুদ রানা নামে এক প্রবাসী লেখক উল্লেখ করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার বয়স থাকার পরও ‘সৃষ্টিকর্তার’ ইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে যাননি জাফর ইকবাল। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফিল্টার উদ্ভাবন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধপ্রেমিক  হয়েছিলেন। তবে, যে-ফিল্টার তিনি উদ্ভাবন করেছেন, তার ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আমার মনে হচ্ছে, অধ্যাপক জাফর ইকবাল অনেকটা ম্যারি শ্যালির গল্পের সেই তরুণ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো, যার তৈরি করা দানব শেষ পর্যন্ত তাকেও মারতে উদ্যত হয়।’
সংসদ সদস্য মাহমুদ-উস সামাদ চৌধুরী বনাম লেখক-শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের দ্বৈরথে এখন বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এ লড়াইয়ের শেষ হবে কিভাবে?

No comments

Powered by Blogger.