৬শ কোটি টাকা নিয়ে হাওয়া ইয়াসিন গ্রুপের মালিক by লোকমান চৌধুরী

দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্র খাতুনগঞ্জের ইয়াসির গ্রুপের মালিক মোজাহের হোসেন ব্যাংক ঋণ ও পাওনাদারদের ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে বিদেশে আত্মগোপনে আছেন দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে। দেনা পরিশোধ না করলেও তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুই রয়েছে সচল। মোজাহেরের আপন ভাই মোজাম্মেল হোসেন পাওয়ার-অব-অ্যাটর্নি নিয়ে ব্যবসা চালালেও পাওনাদের টাকা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। ব্যাংক ঋণও ঝুলে আছে একইভাবে। এ অবস্থায় পাওনা টাকা আদায়ে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পাওনাদাররা এক ডজনেরও বেশি মামলা করেছেন তার বিরুদ্ধে। কয়েকটি ব্যাংক তাদের ঋণ আদায়ে তার সম্পত্তিও নিলামে তুলেছে। দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এখানে প্রায়ই ব্যবসায়িক প্রতারণার ঘটনা ঘটে। এ রকম এক প্রতারকের নাম মোজাহের হোসেন। ১০৬ খাতুনগঞ্জের ইয়াসির এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী তিনি। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এলাকায়। ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, একই পণ্য একাধিক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেই টাকা হাতিয়ে নেন মোজাহের হোসেন। এ ক্ষেত্রে হাফিজ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি গুদামজাতকারী প্রতিষ্ঠান তাকে সহযোগিতা করে। পণ্য না থাকার পরও তারা পণ্য আছে বলে মিথ্যা তথ্য দেয়। ২০১৩ সালে কোরবানির ঈদের আগে মোজাহের হোসেনের এ কৌশল প্রথম ধরা পড়ে যখন তার কাছ থেকে খাতুনগঞ্জের হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স ২ হাজার ২০০ টন মসুর ডাল কেনে। এক হাজার ৬০০ টন নেয়ার পরই গুদামে ডাল শেষ হয়ে যায়। বিষয়টি জানানো হলে ঘাটতি পণ্যের বিপরীতে একটি চেক দেয়া হয়। কিছুদিন পর জানে আলম নামে আরেক ব্যবসায়ীও পণ্য কিনে সরবরাহ নিতে পারেননি। এভাবে একের পর এক প্রতারণার ঘটনা জানাজানি হলে একই বছর খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের মধ্যস্থতায় ব্যবসায়ীদের বৈঠক হয়। এ বৈঠকে মোজাহের হোসেনকে তিন মাস সময় দেয়া হয়। কিন্তু তিনি বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন এমন আশংকায় খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের পরামর্শে হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মীর মোহাম্মদ হাসান ২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর কোতোয়ালি থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এর মধ্যেই বিদেশে পালিয়ে যান মোজাহের। ওই সময় খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, ‘মোজাহের হোসেনের কাছে খাতুনগঞ্জের ২৯ ব্যবসায়ীর ১৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বলে আমরা জেনেছি। তা আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’ অন্যদিকে ওই ব্যবসায়ীর কাছে ১০টি ব্যাংক পাবে ৪৮১ কোটি টাকা। ইয়াসির গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, শাপলা ফ্লাওয়ার মিল ও ইয়াসির পলিমারের নামে এ ঋণ নেন।
এদিকে মোজাহের কৌশলে বিদেশে আত্মগোপনে থাকলেও গত দেড় বছর ধরে সচল রয়েছে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। তার ভাই মোজাম্মেল হোসেনকে আম মোক্তারনামা (পাওয়ার অ্যাটর্নি) দিয়ে তার মাধ্যমে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছেন মোজাহের। ৪ নভেম্বর ২০১৩ সালে আম মোক্তারনামাটি সম্পাদিত হয়। সম্পাদনের পর থেকে আগের মতোই বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন জায়গায় স্থাপিত ফ্লাওয়ার মিলে ময়দা উৎপাদন করে তা বাজারজাতও করা হয়। সম্পাদিত ওই চুক্তি অনুযায়ী মোজাহেরের সব ধরনের লেনদেন ও মামলা পরিচালনা এবং ব্যবসা পরিচালনা সব দেখভাল করবেন মোজাম্মেল হোসেন। কিন্তু ২৯ ব্যবসায়ীর ১৫০ কোটি টাকা এবং ব্যাংকের ৪৮১ কোটি টাকার এক টাকাও পরিশোধ করেননি পাওয়ার অফ অ্যাটর্নিপ্রাপ্ত ছোট ভাই মোজাম্মেল। পাওনাদাররা তার কাছে পাওনা টাকা চাইলে তা পরিশোধ করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রতারিত ব্যবসায়ী আকবর অ্যান্ড আযম এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজী আকবর তার ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা তার ভাই মোজাহেরের কাছ থেকে আদায়ে উপপুলিশ কমিশনার বন্দর (ডিসি পোর্ট) বরাবর একটি অভিযোগ করেন। ডিসি পোর্ট তা অনুসন্ধান করে ২৬ জানুয়ারি একটি তদন্ত রিপোর্ট অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) বরাবর পেশ করেন। রিপোর্টে হাজী আকবর ওই পরিমাণ টাকা মোজাহেরের প্রতিষ্ঠানে ইনভেস্টমেন্ট করার সত্যতা উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ তদন্তকালে আম মোক্তারের মাধ্যমে মোজাহের থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত তার ভাই হাজী আকবরের টাকা ফেরত দেবেন বলে অঙ্গীকার করেন। কিন্তু কালক্ষেপণ হওয়ায় হাজী আকবর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আদালতে প্রতারক মোজাহেরের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় একটি সিআর মামলা করেন। মামলা নং-১০১/১৪।
এ ব্যাপারে হাজী আকবর জানান, প্রতারক মোজাহের ব্যবসা করার প্রস্তাব দেন। সরল বিশ্বাসে আমি ইউসিবিএল ব্যাংকে নিজের জায়গা বন্ধক রেখে ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা মোজাহেরকে প্রদান করি। তার সমপরিমাণ টাকার একটি সিকিউরিটি চেক আমাকে প্রদান করেন মোজাহের। তিনি লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় আমি এখন সর্বস্বান্ত।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মোজাহের হোসেনের ভাই পাওয়ার অ্যাটর্নিপ্রাপ্ত মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘যিনি টাকা নিয়েছেন তিনি এখন দেশে নেই। তিনিই পরিশোধ করবেন। আমি কেন পরিশোধ করব। আমার সঙ্গে কারও লেনদেন হয়নি।’
ব্যাংকের পাওনা ৫৫০ কোটি টাকা : ইয়াসির গ্রুপের সম্পত্তি নিলামে তুলতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। এ পর্যন্ত খাতুনগঞ্জের ১২টি প্রতিষ্ঠান আদালতে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা করেছে। ইয়াসির গ্রুপের কাছে ব্যাংকের পাওনা এখন প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা। আর ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, জুবিলী রোডের প্রাইম ব্যাংক পাওনা আদায়ে অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে ৬২ হাজার বর্গফুটের চারতলা শাপলা ফ্লাওয়ার কারখানার ভবনসহ জমি এবং দক্ষিণ পতেঙ্গার জমি নিলামে তুলেছে। প্রায় ১ দশমিক ৭৯ একর জমি নিলামে তোলে ব্যাংকটি। এছাড়া এমভি আল জুবায়ে-১ (বর্তমানে এমভি তুর্শা) নামের লাইটার জাহাজও নিলামে তোলা হয়েছে। ইয়াসির গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির পাওনা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। এর আগে সিটি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখাও ঋণ আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়। ব্যাংক সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের ১০টি ব্যাংক থেকে প্রতিষ্ঠানটি পণ্য আমদানি ও কারখানা স্থাপনের জন্য ঋণ নেয়। ১০টি ব্যাংক হচ্ছে- প্রাইম, সোস্যাল ইসলামী, সিটি, এবি, ব্র্যাক, প্রিমিয়ার, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড, সাউথইস্ট, মার্কেন্টাইল এবং ব্যাংক এশিয়া।
ব্যাংকের মতো পাওনাদার ব্যবসায়ীরাও মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেছেন। এ পর্যন্ত ২৯ ব্যবসায়ীর মধ্যে ১২ জন মহানগর দায়রা জজ আদালতে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা করেছেন। ইয়াসির গ্রুপের কাছে এ ১২ ব্যবসায়ীর পাওনা রয়েছে ১০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে হাজী মীর আহম্মদ সওদাগর ৩৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা, জাহেদ ব্রাদার্স সাড়ে ১২ কোটি টাকা, জানে আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স ৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, চিটাগাং সিন্ডিকেট ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আদায়ে মামলা করে।

No comments

Powered by Blogger.