কি ঘটেছিল সেই রাতে- আদিবাসী তরুণী গণধর্ষণ: ক্ষোভ, প্রতিবাদ সর্বত্র by রুদ্র মিজান

প্রতিদিনের মতোই কর্মস্থল থেকে বের হন আদিবাসী তরুণী। অন্যান্য দিনের চেয়ে বাসের সংখ্যা ছিল কম। কিছুটা জায়গা হেঁটে সামনের বাসস্টপেজের দিকে এগোতেই ঘটে ঘটনাটি। আচমকা একটি মাইক্রোবাস থামে তার সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই যুবক তাকে কোলে করে গাড়িতে তোলে। এর মধ্যে এক যুবক তার মুখ চেপে ধরে। তার পরেই একের পর এক দুর্বৃত্তদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন ওই তরুণী। বিভীষিকাময় ওই রাতের কথা এভাবেই স্বজনদের কাছে বর্ণনা করেছেন তিনি। পুলিশের কাছে পাঁচ নির্যাতনকারীর চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে এক যুবকের নামও জানিয়েছেন। নির্যাতিতা তরুণীর বর্ণনা অনুসারে বারিধারা, বাড্ডা, গুলশান, বনানী এলাকার বিত্তশালী বখাটে থেকে শুরু করে সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারীদের তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট থানা ছাড়া ন্যক্কারজনক এই ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। শিগগিরই ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলেই আশা করছে পুলিশ।
গতকাল সরজমিন ঘটনাস্থ কুড়িল বিশ্বরোডে গিয়ে দেখা গেছে, ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ২৫০ ফুট দক্ষিণে বসুন্ধরা আবাসন এলাকার ফটক। ঘটনাস্থল থেকে সামনের দিকে আরও প্রায় ২৫০ ফুট দূরত্বে কুড়িল ফ্লাইওভার। এই দুটি স্থানে প্রতিরাতেই পুলিশের পিকআপ ভ্যান অবস্থান করতে দেখা যায় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ঘটনাস্থলের পেছনে বাসস্ট্যান্ড। ঘটনাস্থল থেকে দু-এক মিনিট হাঁটলেই কুড়িল মোড়। সেখানেও যাত্রী উঠায়-নামায় বাসগুলো। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ৯টার দিকে বাস না পেয়ে কুড়িল মোড়ের দিকে হাঁটছিলেন ওই তরুণী। নির্যাতিতা ওই তরুণী তার স্বজনদের জানিয়েছেন, তাকে জোর করে ছাই রঙের মাইক্রোবাসে উঠানোর পরই দুই জন দুই পাশ থেকে তাকে চেপে ধরে। চিৎকার করার চেষ্টা করলে মুখ আরো চেপে ধরে তাদের একজন। অন্য দুজন তার হাত ধরে রাখে। চিৎকার করলে গুলি করে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয় তারা। হুমকিতে ভয় পেয়ে যান ওই তরুণী। গাড়িতে ছিলো পাঁচ যুবক। তাদের প্রত্যেকের বয়স ২২ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। যুবকদের একজন গাড়ি চালাচ্ছিল। বাকি চারজনই ব্যস্ত ছিল ওই তরুণীকে নিয়ে। এসময় তারা উচ্চ আওয়াজে গান ছেড়ে দেয়। প্রথমেই যুবকরা তার ওড়না টেনে ফেলে দেয়। তারপর মাইক্রোবাসের মধ্যের সিটে ফেলে একের পর এক নির্যাতন করতে থাকে। বারবার তাদের কাছে অনুনয় করেছেন তিনি। বলেছেন, ভাই আমাকে এবার ছেড়ে দেন। আপনাদের বোন মনে করে আমাকে ছেড়ে দেন।
দুর্বৃত্তরা তখন হেসেছে। এমনকি একে একে পাঁচ জনই ওই তরুণীকে পাশবিক নির্যাতন করেছে। চালক যুবকটি যখন নির্যাতন করে তখন আরেক যুবক গাড়ি চালাচ্ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, তারা পাঁচ জনই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গাড়িতে তারা পানীয় পান করেছে। তবে তা কোন ধরনের পানীয় তা বলতে পারেননি নির্যাতিতা তরুণী। গাড়িতে নির্যাতন চলাকালীন ওই তরুণী বারবার বাসায় যাওয়ার আকুতি জানালে দুর্বৃত্তরা জানতে চায়, বাসা কোথায়। বাসার ঠিকানা জানানোর পর রাত পৌনে ১১টার দিকে উত্তরা পূর্ব থানা এলাকার জসিম উদ্দিন সড়কে নামিয়ে দেয় তাকে। নির্যাতিতা তরুণীর বরাত দিয়ে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, ঘটনার সময় দুর্বৃত্তদের একজনের ফোনে কল এলে তা রিসিভ করছিল না সে। এ সময় অন্য যুবক তাকে নাম ধরে ফোন রিসিভ করতে বলে। তদন্তের স্বার্থে ওই নামটি গণমাধ্যমে প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ। ওই নাম ও তাদের চেহারার বর্ণনা অনুসারে কয়েক জনের একটি তালিকা করেছে পুলিশ। তালিকা অনুসারে শুক্রবার রাত থেকেই বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে দায়েরকৃত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নির্যাতিতার বর্ণনা অনুসারে তালিকা করে বিভিন্নস্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। সন্দেহমূলক ব্যক্তিদের আটক করলেই তরুণীকে দিয়ে শনাক্ত করানো হবে। ধর্ষকদের দেখলে চিনতে পারবেন বলে জানিয়েছেন নির্যাতিতা তরুণী।
কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার যে দোকানের সামনে থেকে ওই তরুণীকে তোলে নিয়ে যাওয়া হয় ওই দোকানের নাম সিনহা মটরস। ঘটনার সময় দোকানটি বন্ধ ছিল। এমনকি পাশের সোনালী ফার্মেসিটিও বন্ধ ছিল। সিনহা মটরসের মালিক সবুজ মিয়া জানান, রাত ৯টার দিকে দোকান বন্ধ করে চলে যান তিনি। পার্শ্ববর্তী  নিউ তাজ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস খোলা থাকলেও তরুণী তুলে নেয়ার দৃশ্য দেখতে পাননি তিনি। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক জাকির হোসেন বলেন, যমুনা ফিউচার পার্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছেলেমেয়েরা এখান থেকে বাসে উঠা-নামা করেন। মুখ চেপে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার কারণেই তিনি শব্দ শুনতে পাননি বলে জানান। ওই দুটি দোকানের পাশে চা বিক্রি করেন মুহাম্মদ বাবুল। সাধারণত রাত ১০টা পর্যন্ত তার চায়ের দোকান খোলা থাকলেও ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি দোকান বন্ধ করে দেন। বাবুল বলেন, সন্ধ্যায় বৃষ্টি হওয়ার কারণে দোকান বন্ধ করে দিই। যমুনা ফিউচার পার্কের দ্বিতীয় তলার যে পোশাকের শো-রুমে ওই তরুণী কাজ করেন সেখানে গেলে কথা হয় ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানের সহকারী ইনচার্জ মুহাম্মদ ইব্রাহিম জানান, প্রায় পাঁচ মাস ধরে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ওই তরুণী। কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করেছে বলে কোনদিন অভিযোগ করেননি তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী সেলসগার্ল কাকলী বলেন, ওই তরুণী বেপরোয়া চলাফেরা করতেন না। কেউ তাকে উত্ত্যক্ত করতো বলেও জানা নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের উপ-কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ধর্ষণকারীরা তরুণীর পূর্ব পরিচিত না। তবে ধর্ষকদের মধ্যে একজনের নাম ও অন্যদের চেহারার বর্ণনা জানা গেছে। এ ঘটনায় সিসি ক্যামেরার কোন ফুটেজ পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ধর্ষণকারীদের শনাক্ত করতে কয়েকটি টিম কাজ শুরু করেছে। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও তদন্তে নেমেছে। ওই তরুণীকে গাড়িতে উঠানোর স্থান এবং পুরো রাস্তায় যেখানে যেখানে মনে করতে পারবে সে স্থানগুলোকে তদন্তের আওতায় থাকবে। সেসব স্থানে সিসি ক্যামেরা থাকলে তার ফুটেজ সংগ্রহ করা হবে। গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে গুলশানে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।
ঘটনার পর শুক্রবার দুপুরে ভাটারা থানায় এ বিষয়ে মামলা করা হয়। মামলার পর পরই নির্যাতিতা তরুণীকে তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই তরুণীর মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো হয়। পরীক্ষা শেষে দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান মো. হাবিব-উজ-জামান চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গণধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। সাত দিনের মধ্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানান তিনি। ওই তরুণীর শারীরিক পরীক্ষা করেছেন মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক প্রভাষক ডা. মমতাজ আরা।  উল্লেখ্য, ওই তরুণী বড় বোনের সঙ্গে উত্তরায় থাকেন খালার বাসায়। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলায়।
ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন
রাজধানীতে চলন্ত মাইক্রোবাসে তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আয়োজিত এক মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানানো হয়। বিকাল পাঁচটায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ‘গারো ছাত্র ইউনিয়ন’ এবং ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নির্দলীয় ছাত্রজোট’ সংগঠনের ব্যানারে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেয়। মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এসময় তাদের হাতে ‘হে রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা কোথায়?’, ‘আর কতো নারীর সম্ভ্রম দিলে রাষ্ট্র তুমি জাগবে?’, ‘ধর্ষণকারীদের ফাঁসি চাই’, ‘নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করো’ ইত্যাদি লেখা সম্বলিত প্লাকার্ড শোভা পায়। ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধন শেষে আলোক প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে  প্রতিবাদ কর্মসূচি শেষ হয়। এদিকে আদিবাসী তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে এসব সংগঠনের পক্ষ থেকে।

No comments

Powered by Blogger.