মিয়ানমার উপকূলে ২শ অভিবাসী উদ্ধার

কদিন আগেও অথৈই সাগরে ভাসছিল তারা। ইন্দোনেশিয়ার
আশ্রয় কেন্দ্রে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পেয়ে
অবৈধ অভিবাসী কিশোরের আনন্দ অবগাহন -এএফপি
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সাগরে ভাসমান নৌকা থেকে শুক্রবার ২০৮ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে মিয়ানমারের নৌবাহিনী। এতে প্রায় ২শ’ জন ‘বাঙালি’ রয়েছেন বলে দেশটির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানব পাচার নিয়ে প্রথম দিকে নীরব থাকলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দুদিন আগে দেশটি অভিবাসীদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে বলে ঘোষণা দেয়। এরপর এই প্রথম সাগর থেকে অভিবাসী উদ্ধার করল মিয়ানমার। এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বঙ্গোপসাগর ও আন্দামানে ভাসমান আরও প্রায় ৭ হাজার অভিবাসীকে উদ্ধার করতে চারটি জাহাজ নিয়োজিত করেছে মালয়েশিয়া। ইন্দোনেশিয়াও উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। অসহায় অভিবাসীদের উদ্ধারে প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। বৃহস্পতিবার দেশটি বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করতে ইচ্ছুক। এদিকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীরা। এএফপি, বিবিসি, রয়টার্সসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও মালয়েশিয়া থেকে যুগান্তর প্রতিনিধির পাঠানো খবর-
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশের জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা টিন মাউং সোয়ে বলেন, ‘সাগরে টহল দেয়ার সময় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ দুটি নৌকা খুঁজে পায়। এর মধ্যে একটি নৌকা থেকে ২০৮ জনকে উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে প্রায় ২শ’ জন ‘বাঙালি’। আর দ্বিতীয় নৌকাটি খালি ছিল।’
যদিও মিয়ানমারে বাঙালি শব্দটি মূলত রোহিঙ্গা মুসলিমদের বোঝাতে ব্যবহার করেন দেশটির কর্মকর্তারা। মিয়ানমারে বসবাসকারী প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশটিতে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
টিন মাউং সোয়ে জানান, তাদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়েছে এবং খাবার ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যগত সহায়তা দেয়া হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের আন্দামানে এখনও প্রায় ৭ হাজার অভিবাসী নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে শুধু মিয়ানমার উপকূলে পাঁচটি নৌকায় প্রায় ২ হাজার অভিবাসী ভাসছেন বলে তিন দিন আগে জানায় জাতিসংঘ। পাচারকারীরা তাদের নৌকা নিয়ে আন্দামান সাগর পার হতেও চাইছিল না- আবার নৌকার আরোহীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় না করে তাদের ছেড়েও দিতেও অনাগ্রহী ছিল।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে নৌকা থেকে অভিবাসী উদ্ধার করলেও মিয়ানমারের মন্ত্রীরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় যারা মিয়ানমারের নাগরিক বলে প্রমাণিত হবে, শুধু তাদেরই তারা সে দেশে থাকতে দেবে। মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় একটি নৌকার ছবি পোস্ট করা হয়। তাতে খোলের ভেতর গাদাগাদি করে থাকা মানুষদের দেখা যায়। ওই পোস্টেও তাদের বাঙালি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিয়ানমার বলছে, ওই দুটি নৌকা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের অদূরে বাংলাদেশের জলসীমায় ছিল এবং আরও ছোট ছোট নৌকায় আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদেও নৌকায় তোলার অপেক্ষায় ছিল। বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমেরিকার ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর এই উদ্ধার তৎপরতা চালানো হল। শুক্রবার একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমার জলসীমায় অবৈধ অভিবাসী নিয়ে কয়েকটি নৌযান এখনও অপেক্ষমাণ রয়েছে। এই অভিবাসীদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপ গমনকারী হাজার হাজার অভিবাসী পুরো বিশ্বকে এক মানবিক প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে বলেছেন ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান এলহাজ অ্যাস সাই। ‘শুধু আমাদের মানবতার পরীক্ষা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি উত্তীর্ণ হতে পারব?’ সম্প্রতি এশিয়াতে অভিবাসন বিষয়ক এক সম্মেলন শেষে জেনেভায় এসে এএফপিকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশ্ব নেতাদের কাছেই হয়তো প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সাগরে নৌকায় ভাসমান অধিবাসীদের উদ্ধারের লক্ষ্যে বৃহস্পতিবার মালয়েশিয়া সরকার এক অভিযান নামানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। শুক্রবার দেশটি জানায়, তারা চারটি জাহাজ দিয়ে অভিবাসীদের উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে। ইন্দোনেশিয়াও উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান দেশটির ডেপুটি সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অভিবাসী সংকট নিরসনের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। সবাই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মেরি হার্ফ বলেন, ‘অভিবাসীদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে জাতিসংঘ অভিবাসন এজেন্সির নেতৃত্বে বহুজাতিক প্রচেষ্টায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।’
স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন তারা : এদিকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেয়া অভিবাসীরা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছেন। সেখানে অভিবাসীদের শুশ্রূষায় এগিয়ে আসা মানবাধিকার সংস্থার কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ছবিতে দেখা গেছে, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অভিবাসী শিশুরা খেলছে। কেউ কেউ হাসিমুখে গোসল করছে। একসঙ্গে খেতে বসেছে কেউ কেউ। দেখা গেছে, চুল-দাড়ি কামাতে তারা একজন অন্যজনকে সহায়তা করছেন। ইতিমধ্যে ওইসব আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় তিন হাজারের মতো অভিবাসী স্থান পেয়েছেন। মালয়েশিয়ার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শিশুরা পড়াশোনা করারও সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠানো হবে : মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ড. ওয়ান জুনাইদি তুয়াঙ্কু জাফর বলেন, শরণার্থীবিষয়ক কাগজপত্র চূড়ান্ত করার পরই অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এর আগে ঢাকায় আইওএম’র মুখপাত্র আসিফ মুনীর জানান, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেয়া অভিবাসীদের তালিকা তৈরি শুরু হয়েছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের একটি অনুরোধে তারা সম্মতি দিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ায় আসা অবৈধ বাংলাদেশীদের সঙ্গে আরও রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। তাদের জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ইউএনএইচসিআরের হাতে তুলে দেয়া হবে। আর অবৈধ বাংলাদেশীদের কাগজপত্র সম্পন্ন হওয়ামাত্রই তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। ড. ওয়ান জুনাইদি তুয়াঙ্কু জাফর রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুকে মিয়ানমারের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করেন। এ বিষয়টির সমাধান করতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। উপমন্ত্রী বলেন, অবৈধ প্রবেশের দায় নিতে পারে না মালয়েশিয়া। ওই দেশে চাকরির জন্য লাখ লাখ অবৈধ শ্রমিকের সমস্যা মোকাবেলা করছি। এতে স্থানীয় সামাজিক জীবনে ব্যাপক সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। চাকরি ক্ষেত্রে স্থানীয়রাও সমস্যায় ভুগছেন। অনেক ক্ষেত্রে এসব অবৈধ মানুষ বহন করে আনছে নানা রোগব্যাধি। এই রোগবালাই ছড়াচ্ছে আমাদের দেশে। তিনি বলেন, অবৈধ প্রবেশকারীদের স্বাগত জানাবে না মালয়েশিয়া। আর রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সেটা তো মিয়ানমারের সমস্যা।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়া লেবার কনস্যুলার সাইদুল ইসলাম মুকুল বলেন, লাঙ্কাবি আটক বাংলাদেশী শ্রমিকদের খোঁজখবর নেয়ার জন্য আমি ছুটে গিয়েছি। সেখানে আমাদের বাংলাদেশী শ্রমিকদের কোনো প্রকার যেন নির্যাতন না করা হয় বাংলাদেশ হাইকমিশনের তরফ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। তারাও আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। কোনো প্রকার হয়রানি করা হবে না। বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আমরা জেনেছি আমাদের শ্রমিকদের খুব শিগগিরই দেশে পাঠানো হবে।

No comments

Powered by Blogger.