ইলিয়াসের অপেক্ষায় তিন বছর by কাফি কামাল

অপেক্ষায় কেটে গেছে তিনটি বছর। পরিবার, স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে এখনও ফিরে আসেনি বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলী। কেউ জানে না তিনি জীবিত না মৃত। তবুও তাকে ফিরে পেতে এখনও আশাবাদী তার পরিবার। ২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল রাত সাড়ে ১১টায় দীর্ঘদিনের আড্ডাস্থল হোটেল রূপসী বাংলা থেকে বনানীর বাড়িতে ফেরার পথে নিখোঁজ হন তিনি। তার নিখোঁজের ৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ইলিয়াস আলী কি বেঁচে আছেন? তার সন্ধান কি আর কোন দিনই পাওয়া যাবে না? এমনটাই প্রশ্ন সবার মনে। সেদিন নিজের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরে মহাখালীর আমতলী মোড় থেকে তাকে চালকসহ অপহরণ করা হয়। জানা যায়, হঠাৎ পেছন থেকে একটি গাড়ি তার গাড়িতে আঘাত করে। গাড়ি থেকে নেমেছিল চালক আনসার। দ্রুত তাদের মারধর করে দুটি গাড়িতে তুলে নেয়া হয় অজানার উদ্দেশে। পরিত্যক্ত অবস্থায় তার গাড়িটি পড়ে থাকে সেখানে। ঘটনার অন্তত দুইঘণ্টা পর রাত দেড়টায় পুলিশ ফোন করে পরিত্যক্ত গাড়ির কথা জানায় ইলিয়াসের পরিবারকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা নানা সময়ে গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ইলিয়াস আলীকে যখন তুলে নেয়া হয় তখন তাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন কাছেই ডিউটিরত এক পুলিশ কর্মকর্তা। চিৎকার চেঁচামেচি শুনেছিল পাশের নির্মাণাধীন ভবনের প্রহরীরা। নিজের চোখে দেখেছেন মোড়ের ডাব বিক্রেতা। ঘটনার বিহ্বলতা কাটিয়ে পরদিন গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলার চেষ্টা করেছিলেন তাদের কেউ কেউ। কিন্তু তারপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ নেই। প্রথম কয়েকদিন গুমের বিষয়টিকে পাত্তাই দেয়নি সরকার। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কেউ বলেছেন, খালেদা জিয়ার পরামর্শে আত্মগোপনে গেছে ইলিয়াস। কেউ বলেছেন, দলের লোকজনই তাকে অপহরণ করেছে। গুমের চারদিনের মাথায় প্রথম র‌্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে ইলিয়াসের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুরের পুবাইল এলাকায় নিষ্ফল অভিযান চালায়। এরপর ইলিয়াসের খোঁজে আর কোন অভিযান দৃশ্যমান হয়নি। জানা গেছে, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজবাড়ী, সিলেটের ভারতীয় সীমান্তবর্তী কিছু চা-বাগানে কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। প্রথম থেকেই বিএনপির তরফে অভিযোগ ইলিয়াসকে তুলে নিয়ে গেছে সরকারি কোন বাহিনীর সদস্যরা। ইলিয়াসের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় বিএনপি হরতাল ডাকে। ২০১২ সালের ২৩শে এপ্রিল হরতালের দিন বিশ্বনাথ থানা ঘেরাও করতে উপজেলার বিভিন্নস্থান থেকে এলাকাবাসী মিছিল নিয়ে এগোতে থাকে বিক্ষুব্ধ জনতা। পুলিশের গুলিতে সেখানে তিনজন প্রাণ হারান। সারা দেশে প্রাণ দেন ৮ জন। ইলিয়াসের সন্ধান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার পরিবার। প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়েছেন তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদীরকে। মাথায় হাত বুলিয়েছেন তার সন্তানদের। উদ্ধারে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঈদের উপহার হিসেবে বাবাকে ফেরত চেয়েছিল তার ছোট্ট মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল। ইলিয়াস ইস্যুতে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে চিঠি দেয় বিএনপি। বাংলাদেশ সফররত তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে পিতার সন্ধানে সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল ইলিয়াসের মেয়ে সাইয়ারা নাওয়াল। বাংলাদেশ সরকারকে স্বাধীন তদন্তের অনুরোধ জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যুক্তরাজ্য সরকার ও ইইউ’র ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরাও অনুরোধ জানিয়েছেন। ইলিয়াসকে উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের কাছে আহ্বান ও অনুরোধ জানিয়েছেন অসংখ্য দেশী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। কিন্তু এখনও সন্ধান মেলেনি ইলিয়াসের। গুম হওয়ার পর নানা সময়ে ইলিয়াসের মোবাইল নাম্বার থেকে ফোন আসার দাবি করেছেন অনেকেই। ইলিয়াসের ব্যাপারে তদন্তের অগ্রগতি জানাতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। প্রথম কিছুদিন তা জানানো এবং গণমাধ্যমে সংবাদও হয়েছিল। কিন্তু এখন তদন্তের অগ্রগতি জানানো হয় কিনা জানা যাচ্ছে না। ইলিয়াস এবং তার গাড়িচালক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় একটি মামলা পর্যন্ত হয়নি। নিখোঁজ হওয়ার পরদিন ইলিয়াসের স্ত্রী এ ঘটনায় বনানী থানায় একটি জিডি করেন। পুলিশ এখনও সেই জিডির সূত্র ধরেই মামলার তদন্ত করে যাচ্ছে।
আল্লাহর উপর ভরসা করে আছি: লুনা
ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, তিনটি বছর পেরিয়ে গেল কিন্তু আমাদের অপেক্ষার শেষ হলো না। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করা ছাড়া আমাদের আর কিইবা আছে। ইলিয়াস নিখোঁজ হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে উনার সহযোগিতা চেয়েছিলাম। তিনি আমাদের সান্ত্বনাও দিয়েছিলেন। যদিও কোন অগ্রগতি হয়নি। পরে কয়েকবার চেষ্টা করলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ আর পাইনি। তিনি বলেন, প্রথম কয়েক মাস আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী খোঁজ-খবর করতেন। কিন্তু দুই বছরের বেশি সময় ধরে তাদের কোন উদ্যোগ দেখিনি। আমাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেনি। লুনা বলেন, পুলিশ কয়েকমাস আদালতে রিটের জবাব দিয়েছিল। কিন্তু সেখানেও ইতিবাচক কোন উদ্যোগ দেখিনি। বছর খানেক আদালতের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। সবখানেই কেবল অনিশ্চয়তা। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত ইলিয়াসের অপেক্ষা পার করেছি আমরা। আমাদের তিন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের বড় ছেলেটি এবার এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য তার বৃটেনে যাওয়ার কথা আছে। মেঝ ছেলেটি এবার নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। মেয়েটি ক্লাস ফাইভে পড়ছে। ইলিয়াসের অনুপস্থিতি তাদের সবসময় মানসিকভাবে বেদনার্ত করে রাখে। তিনি বলেন, ইলিয়াস নিখোঁজ হওয়ার পর আমাদের জগৎ সীমিত হয়ে পড়েছে। আমি একটি চাকরি করি, সামান্য আয়ে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়েই চলে সংসার। লুনা বলেন, ইলিয়াসের সন্ধান দাবিতে বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগরে প্রতি মাসের ১৭ তারিখে কর্মসূচি পালন করে ইলিয়াস মুক্তি পরিষদ। মাঝে মধ্যে দলের নেতারা তাদের বক্তব্যে ইলিয়াসের নাম স্মরণ করে, তার সন্ধান ও মুক্তি দাবি করে এটুকুই এখন আমাদের সান্ত্বনা। ইলিয়াসের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদটি থাকলেও সিলেট জেলা কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে। সেখানে অবশ্যই আমাকে প্রথম সদস্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে মাঝে-মধ্যে সাক্ষাৎ করি। সর্বশেষ তিনি অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় জানুয়ারি মাসে গুলশান কার্যালয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। মাঝে মধ্যে নেতারা খোঁজ-খবর নেন। ইলিয়াসের নিখোঁজের দিন আজ দলের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনের নেতৃত্বের একটি প্রতিনিধি দল আমাদের বাসায় আসার কথা আছে। ওদিকে এখনও থামেনি ইলিয়াসের মা সূর্যবান বিবির চোখের জল। সন্তান হারা বৃদ্ধা মাকে সান্ত্বনা দিতে প্রতিদিন তাদের গ্রামের বাড়িতে যান নেতাকর্মীসহ এলাকার মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.