লেভেল প্লেয়িং by মাহবুব তালুকদার

চাচা জিজ্ঞাসা করলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মানে কী?
বললাম, সবার জন্য সমান সুযোগ। মানে, নির্বাচনের মাঠে সবাই যাতে সমানভাবে খেলতে পারে, তার সুযোগ সৃষ্টি করা।
কিন্তু বিএনপি কিভাবে তা আশা করতে পারে? চাচা বললেন, ‘নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা’ বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। বিএনপি এখন উঠোন বাঁকা বলে চেঁচাচ্ছে। নিজেরা নাচতে না পারলে উঠোনের দোষ দিয়ে লাভ কি?
উভয়ের জন্য সমতল ভূমি হওয়া কি উচিত নয়? আমি বললাম।
তুমি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে এক পাল্লায় মাপতে চাচ্ছ। আর শুধু স্বাধীনতা বিরোধীই বা বলি কেন? ওরা নাশকতাকারী ও মানুষ হত্যাকারী। যারা পুড়িয়ে মানুষ মারে, তাদেরকে যে নির্বাচনে আসতে দেয়া হয়েছে, এই তো বেশি।
নির্বাচনে সবাইকে প্রার্থী হতে ও ভোট দিতে সমান সুযোগ দিতে হবে।
সে তো দেয়া হচ্ছেই। আমাদের নির্বাচন কমিশনের মতো এমন উদার প্রতিষ্ঠান বিশ্বের আর কোথাও দেখাতে পারবে না। তবে তারা নিরপেক্ষ নয়।
আমি তো সেই কথাই বলতে চাচ্ছি।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ তা জানি না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। চাচার বক্তব্য।
সে কি! এর কোন প্রমাণ আছে কি?
অবশ্যই আছে। তারা মন্ত্রীদের ওপর পর্যন্ত শোকজ নোটিশ জারি করতে চায়।
মন্ত্রী হয়ে কেউ কোনো প্রার্থীর জন্য ভোট চাইতে পারেন না।
কে বললো পারেন না! মত প্রকাশের স্বাধীনতা তার অবশ্যই আছে।
নির্বাচনী বিধিতে প্রার্থীর পক্ষে মন্ত্রীর প্রচারণা চালানোর অধিকার খর্ব করা হয়েছে।
নির্বাচনী বিধি! সেটা কি সংবিধানের ওপরে? সংবিধান যেখানে প্রতিটি নাগরিককে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, সেখানে একজন মন্ত্রী মত প্রকাশ করতে পারবেন না কেন? কাকে ভোট দিতে হবে, তা জনগণকে চিনিয়ে দেয়া বা গাইড করা একজন মন্ত্রীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। দেশের মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়া তার দায়িত্ব।
চাচা! আপনার এ কথার পর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আর আশা করা যায় না।
আবার তুমি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলছো? আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে দেবে না। অন্যদিকে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া ইচ্ছামতো নির্বাচনী প্রচারণা চালাবেন, এটা কেমন লেভেল প্লেয়িং?
চাচার সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলে কোন লাভ নেই। মন্ত্রী মহোদয়রা নির্বাচনী প্রচারণা চালালে নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তারা দায়সারা গোছের নোটিশ দেয়া আর কাউকে কাউকে সামান্য জরিমানা করা ছাড়া আর কি করতে পারছে? এতে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার আশা সুদূরপরাহত।
আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। অভিযোগ আছে, বিরোধী দলের যেসব নেতাকর্মী আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছিল, তাদেরকে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে আটক করা হচ্ছে। বিএনপির নির্বাচন প্রচারণা মিছিল থেকেও নেতাকর্মীদের তুলে নেয়া হচ্ছে। এতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মনে উদ্বেগ ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। অবস্থা এমন যে, ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে যদি তাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলেও বলার কিছু থাকবে না। অনেক প্রার্থী নিজের ভোটটি দেয়ার জন্য ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না।
আমার সবচেয়ে দুঃখ লাগে ঢাকাকে দু’ টুকরো করা হলো বলে। দ্বিখণ্ডিত করার সময় বলা হয়েছিল, এতে নাকি নাগরিক সেবার মান বাড়বে। এ রকম তুঘলকি সিদ্ধান্তে এক ফোঁটা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি।  আসলে তা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কৌশল ছাড়া আর কিছু ছিল না। বরং প্রশাসক দিয়ে মেয়রের কাজ করাতে গিয়ে সিটি করপোরেশন জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আজ যদি রাজধানী ঢাকা দিল্লি বা অন্যান্য বড় শহরের মতো আলাদা স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়াতে পারতো, তাহলে তার চেহারা পাল্টে যেতে পারতো। খণ্ডিত বা দ্বিখণ্ডিত ঢাকা দিয়ে তা কখনোই সম্ভব নয়। চারশত বছরের এই মহানগরীর বুকে ছুরি মারার আগে আমাদের হাত এতটুকু কাঁপলো না!
আমি যখন এসব কথা ভাবছি, তখন চাচা বললেন, কী ব্যাপার, এতো চুপচাপ কেন?
বললাম, ভাবছি।
নির্বাচনের কথা তো? এবার নির্বাচনে ঢাকাবাসীর উচিত আনিসুল হক আর সাঈদ খোকনকে জয়যুক্ত করা।
কেন?
বিএনপি বা তাদের সমর্থিত কোন প্রার্থী মেয়র হলে কাজ চালাতে পারবে না।
কেন?
এর খুব সহজ উত্তর। মির্জা আব্বাস আত্মগোপনে থেকে জয়ী হলে লাভ কি হবে? উনি তো মেয়রের চেয়ারে বসতে পারবেন না।
উনি আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলে?
প্রকাশ্যে এলে উনি জেলে যাবেন। মেয়রের চেয়ার তার কাছে দূর অস্ত!
কিন্তু ঢাকা উত্তর? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
সেখানে তো বিএনপির উল্লেখযোগ্য কোন প্রার্থীই নেই। অন্য দল থেকে হায়ার করে প্রার্থী যোগাড় করে কি আর নির্বাচনে জয়ী হওয়া যাবে?
বিএনপি ইতিমধ্যে নিজেদের প্রার্থী দিতে যাচ্ছে।
সেটা হবে কানা-খোঁড়া প্রার্থী।
কেন এ কথা বলছেন?
কানা এ জন্য যে, উপযুক্ত প্রার্থী না হলে তিনি কোন ভোটার খুঁজে পাবেন না। মানে, ভোটারদের দেখা পাবেন না। আর খোঁড়া বলছি এ কারণে যে, তিনি ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে পারবেন না। অর্থাৎ তার তেমন সচলতা থাকবে না।
চাচা! আপনি খুব কঠোর কথা বলেছেন। বিএনপি আপনার ভাষায় কোন ‘উপযুক্ত’ প্রার্থী দিতে পারলে কি হবে?
উপযুক্ত প্রার্থীরা সবাই নাশকতার সঙ্গে জড়িত ইনক্লুডিং খালেদা জিয়া। তাদের ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নেয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। তাদের ভবিষ্যৎ কি, তা আশা করি বুঝতে তোমার অসুবিধা হবে না। তবে যদি মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা না যায়, তাহলে তার নির্বাচন প্রচারণা দলের লোকজন বা কাউন্সিলর পদের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ আনা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত।
এই পর্যায়ে চাচি ঘরে ঢুকলেন। চাচিকে দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম এ কারণে যে, তার উপস্থিতিতে চাচার কথাবার্তায় কিছুটা ভারসাম্য আসবে। চাচি জিজ্ঞাসা করলেন, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তো?
হ্যাঁ। আমি বললাম, চাচা আওয়ামী লীগের সব প্রার্থীকে একচেটিয়াভাবে জিতিয়ে দিচ্ছেন।
নির্বাচন করে, না নির্বাচন না করে?
চাচা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, নির্বাচন না করে মানে?
মানে খুব সোজা। আওয়ামী লীগের একটা কৌশল আছে না? বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া। এখানেও কি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার কথা বলা হচ্ছে?
সেটা সম্ভব নয়। বিএনপি নির্বাচন বয়কট করলে তা সম্ভব ছিল। নির্বাচনে বিএনপি থাকবেই। আমি জানালাম।
তাহলে নির্বাচনের ফলাফল আগাম ঘোষণা করা সম্ভব নয়। ক্রিকেটের ফলাফলই আগাম বলা যায় না। আর এতো নির্বাচন! চাচি বললেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, চাচি! আপনি কী মনে করেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে?
এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে- এমন আশা করা নিতান্ত দুরাশা।
চাচা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বিরক্ত স্বরে বললেন, নির্বাচন কমিশনের দোষটা কি?
তারা সরকারের মন্ত্রী বা বিধিবিধান ভঙ্গকারী কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। রিটার্নিং অফিসার মন্ত্রীদের ব্যাপারে বিধিবিধান ভঙ্গের চিঠি লিখলেও নির্বাচন কমিশন মুখ বন্ধ করে বসে আছে।
কেন? নির্বাচন কমিশন তো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছে যে, মন্ত্রীসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। চাচার বক্তব্য।
ঐসব চিঠি চালাচালির মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের কাজ সীমিত। তাদের কার্যকলাপ দেখে মনে হয়, কমিশন সরকারের একটি অনুগত অফিস মাত্র। তারা আওয়ামী লীগের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে।
চাচির কথা শুনে চাচা তীব্র প্রতিবাদ জানালেন, হ্যাঁ। তারা পক্ষপাতিত্ব যদি দেখায়ই সেটা বিএনপির পক্ষে। কারণ খালেদা জিয়া যেখানে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন, শেখ হাসিনা সেখানে কেন নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন না?
খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন, কে বললো? মন্ত্রী শাজাহান খান তো বলে দিয়েছেন, ‘খালেদা জিয়া একজন খুনি। জামায়াত-বিএনপি মানুষ হত্যাকারী। এইসব খুনিদের রাজপথে নামার কোন সুযোগ দেয়া হবে না।’ এরপর খালেদা জিয়া কিভাবে নির্বাচনী প্রচারে নামবেন, তা দেখার বিষয়। চাচি জানালেন।
আমি বললাম, দেশটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারছে না কিছু উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে।
উস্কানিমূলক বক্তব্য কেবল দেখছো। উস্কানিমূলক কার্যকলাপ তো দেখছো না।
বললাম, নতুন করে আর কিছু ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। আমি মনে করি, নির্বাচনী আবহ তৈরির জন্য সবারই শান্ত থাকা উচিত। এ জন্য দু’পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হয় তোমার আপত্তি আছে? চাচি জিজ্ঞাসা করলেন চাচাকে।
নিরপেক্ষতা অর্থ কি তা জানি না। যে কোনভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে জিততে হবে।
কি বলতে চাও তুমি?
আওয়ামী লীগকে জিততে হবে এ জন্য যে, গত ৩ মাসে দেড়শ’ মানুষ পেট্রলবোমায় নিহত হয়েছেন। নির্বাচনে বিএনপি জিতে গেলে দেশে পেট্রলবোমার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। প্রমাণিত হবে আন্দোলনের নামে নাশকতা জনগণ মেনে নিয়েছে।
এটা তো মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের কথা। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা নয়।
না। শুধু মন্ত্রীর কথা নয়। এটা সকল জনগণের কথা। চাচা বললেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মানে হচ্ছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়যুক্ত হওয়া।

No comments

Powered by Blogger.