ওদের শৈশব-কৈশোর ফিরিয়ে দিতে হবে by প্রতীক বর্ধন

ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সিনথিয়া (ছদ্মনাম) চারটি কোচিং সেন্টারে পড়ে। আবার বাসায় এসে তাকে পড়ান আরও দুজন শিক্ষক। প্রতিদিন সকাল আটটায় বাসা থেকে বেরোয় সে, দুটি জায়গায় কোচিং শেষে স্কুলে যায়। মাঝে একবার বাসায় আসে ১৫ মিনিটের জন্য, শুধু খাওয়ার জন্য। এত হাঙ্গামা সেরে সে বাসায় ফেরে সন্ধ্যা ছয়টায়। এসেই আবার গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসে।
হ্যাঁ, এ রুটিন শুধু এক দিন, এক সপ্তাহ বা এক মাসের নয়। দিনের পর দিন ধরে চলছে তার এ জীবনযাত্রা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শিক্ষা তার কাছে কখনোই আনন্দময় মনে হয়নি। ইঁদুর দৌড়টা শুরু হয়েছে পিএসসি দিয়ে, তার পর এসেছে জেএসসি। আর এখন শুরু হয়েছে এসএসসির প্রস্তুতি। তার বিনোদনও বলতে গেলে এখন কোচিংয়ে আসা-যাওয়া। জীবন যেন ঘুরপাক খাচ্ছে স্কুল, বাসা আর কোচিং সেন্টারকে কেন্দ্র করে। এর বাইরে সে আর কিছু করতেও পারে না। অথচ তার কিশোরী মনে কত ভাবনা ছিল, তার সবই যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটির সঙ্গে তার মাকেও একইভাবে ঘোরাঘুরি করতে হয়। দিনকাল যা পড়েছে তাতে তো মেয়েকে আর একা ছেড়ে দেওয়া যায় না। এই করতে গিয়ে তাঁকেও জীবনের অনেক সাধ-আহ্লাদ ছাড়তে হয়েছে। তাঁর মতো অন্য অনেক মায়েরও একই অবস্থা।
স্কুলে এখন পড়ানো হয় না বললেই চলে, তার ওপর আবার পিএসসি, জেএসসিসহ নতুন নতুন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সারা দিন ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। এতে অসাধু শিক্ষকেরা লাভবান হলেও জাতির ভবিষ্যৎ হিসেবে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যে উপকৃত হচ্ছে না, সেটা বলাই বাহুল্য। আবার অনেক অভিভাবকও স্রেফ ভালো ফলাফলের আশায় সন্তানকে স্বেচ্ছায় এমন ইঁদুর দৌড়ে শামিল করছেন।
আরও বিপদের কথা হচ্ছে, এই ছেলে-মেয়েরা সারা দিন এভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকার পর বিনোদন হিসেবে বেছে নিচ্ছে শুধু টেলিভিশন-ফেসবুক-ইন্টারনেট প্রভৃতি বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে। তাদের কৈশোর নেই বললেই চলে। সেই যে দুরন্ত কৈশোর আমাদের ছিল, তা এখন ওদের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই মনে হয়। আবার যারা ঘর থেকে পড়াশোনা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছে, তারাও যে কৈশোরের স্বাদ পাচ্ছে, তাও নয়। তাদেরও দেখা যায়, স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে আছে বা তাদের বয়সের সঙ্গে মানানসই নয়, এমন আচরণ করতে। কথা হচ্ছে, পাড়া-মহল্লায় মাঠ নেই, খেলাধুলা নেই, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই, নেই কোনো পাঠাগার। আর মাদুর পেতে তাদের গল্প শোনানোর মানুষও আর নেই, সেই সময়ও নেই। গল্পের বই এখন আর তাদের তেমন টানে না, যদিও এটা শুধু তাদের একার দোষ না। এর ফলে নানারকম দুর্ঘটনাও ঘটছে। কথা হচ্ছে, বই না পড়লে মানুষের কল্পনার সীমা প্রসারিত হয় না। আর জ্ঞানের জন্য কল্পনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ওদের শৈশব-কৈশোর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণে সমাজে নানা রকম দুর্ঘটনাও ঘটছে। কিশোরী ঐশী যে ওর বাবা মাকে মেরে ফেলল, তার মধ্যেও এই হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের প্রভাব রয়েছে। একজন মানুষের সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে হলে জীবনের বিভিন্ন বয়সের নানা রূপ-রস উপভোগ করতে হবে, তা না হলে শক্তি ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।
শিক্ষার উৎস হিসেবে জীবন, সমাজ বা বাস্তবতা-এসবের কোনো মূল্যই আজ আর শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কাছে নেই। সবকিছু যেন কোচিং সেন্টারেই পাওয়া যায়, এমন এক ধারণার বশে সবাই ছুটছে কোচিং সেন্টারে। বলা বাহুল্য, হাতে গোনা দু একটি স্কুল-কলেজ ছাড়া দেশের বিভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লেখাপড়া হয় না। এই কোচিং সেন্টারের খরচ, যাতায়াত খরচ-এসব বাবদও বাবা-মায়ের ব্যাপক খরচ হচ্ছে। অথচ সংবিধান আমাদের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দিয়েছে! স্কুলে পড়াশোনা না হলেও সেই স্কুলেরই শিক্ষকদের কাছেই শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছে। এ নিয়ে সম্মানিত শিক্ষকের মধ্যেও কোনো লাজ-লজ্জা বা অনুতাপের বালাই নেই। আবার তারা যে বেতন পান, তাতে সংসার চালানোও দায়। এটা কোনো সবল রাষ্ট্রের চরিত্র নয়।
সরকারের নীতি নির্ধারকেরা যদি বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারেন, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যাব, তা বলা মুশকিল। কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেছেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থা দেশে বুদ্ধিজীবী-চিন্তক তৈরি করতে পারবে না। আর এখন তো মনে হচ্ছে, চিন্তক তো দূরের কথা, আমরা বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই পাব কি না, সেটাই চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.