প্রীতিপূর্ণ প্রাণে করি শুভ আবাহন by সৈয়দ আবুল মকসুদ

গ্রীষ্ম ঋতুর বৈশাখ আসে বসন্তের শেষে। বসন্ত আসে শীতের শেষে। শীত একটি দুর্বিষহ ঋতু। প্রাণহীন ঋতু। শীতে প্রকৃতিতে জীবন থাকে না। প্রকৃতি মরতে মরতে কোনোরকমে বেঁচে থাকে। শীতে যেটুকু প্রাণ থাকে, তা-ই আবার মাঘের শেষে ফাল্গুনে সতেজ হতে থাকে। শীতের ঝরা পাতার শাখা-প্রশাখায় ফাল্গুনে গজায় কিশলয়। চৈত্রসংক্রান্তি একটি বছরের বিদায়বার্তা নিয়ে আসে। পয়লা বৈশাখ সূচনা করে নতুন একটি বছরের। বাঙালির নববর্ষ। বাঙালির প্রধানতম ও মহত্তম উৎসব।
বাঙালি হিন্দুর ধর্মীয় উৎসব রয়েছে। বাঙালি বৌদ্ধদের আছে। বাঙালি মুসলমানদেরও আছে ধর্মীয় উৎসব। হিন্দুর ধর্মীয় উৎসবে কোনো মুসলমান অংশ নিতে চাইলে তাতে কোনো বাধা নেই। মুসলমানের উৎসবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানরা যোগ দিতে চাইলে তাতেও বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষই। সেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান-খ্রিষ্টান-আদিবাসী সব এক। এবং তাৎপর্যের বিষয় হলো, বাংলা নববর্ষের ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবে সব ধর্মের উপাদানই আছে। তবে তা যে আছে, তা কোনো ঘোষণা দিয়ে নয়। তা যদি থাকত, তাহলে প্রতিটি ধর্মের মানুষই দাবি করতে পারত তার ধর্মের উপাদানই বেশি।
বাংলা নববর্ষ নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলেই মন চলে যায় দূর অতীতে, আমার শৈশবের দিনগুলোতে। প্রকৃতির বিধান অনুসারেই যেমন আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে আমার অমূল্য শৈশব-কৈশোর, তেমনি আমার সেই শৈশব-কৈশোরের বাংলাও নেই। সেই অভাবী বাংলায় ছিল অন্য রকম গ্রামীণ অর্থনীতি। অন্য রকম শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতি, যা ধর্মীয় উপাদান গ্রহণ করেও একেবারেই ধর্মনিরপেক্ষ। সেকালের বাংলায় ছিল অন্য রকম নিসর্গ। অনেকটাই অন্য রকম খাদ্যাভ্যাস। সবচেয়ে যা মূল্যবান তা হলো, এখনকার চেয়ে একেবারেই অন্য রকম সামাজিক বন্ধন এবং সামাজিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি। ঝগড়াঝাঁটি, কলহ, মারামারি ছিল না, তা নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সামাজিক বন্ধনটা ছিল সুদৃঢ়। সে সমাজ ছিল সব ধর্মের মানুষের বাঙালি সমাজ।
আমার শৈশব-কৈশোরের বৈশাখে বাংলার মাঠ-ঘাট-জনপদ-নদ-নদী নয়, বাংলার আকাশও যেন ছিল অন্য রকম। বৈশাখে সে আকাশে উড়ত রংবেরঙের ঘুড়ি। চৈত্র-বৈশাখে আউশ-আমন ও পাটখেতে কাজ করতে গিয়ে রাখালেরা ওড়াত ঘুড়ি। পাখিদের মধ্যে চিল এখন বিলুপ্তপ্রায়। সেকালে সোনালি চিলের চিকন মধুর সুর শোনা যেত বাংলার আকাশে। কত রকম পাখি ও বন্য প্রাণী যে বৈশাখে দেখা যেত, তার দশ ভাগের এক ভাগও আজ নেই।
মানুষের ঘরবাড়িতে তখন নানা রকম দেশীয় ফুলের গাছ ছিল। বনবাদাড় ও ঘরবাড়ির আনাচকানাচে বৈশাখে ফুটত বেলি, জুঁই, চামেলি, মল্লিকা, কাঁঠালিচাঁপা, ভাটফুল প্রভৃতি। মনে পড়ে, পঞ্চাশের দশকে এক বাংলা নববর্ষের ভোরে প্রতিবেশী এক কিশোরীর ঘন চুলে গুঁজে দিয়েছিলাম একগুচ্ছ বেলি। মেয়েটি মৃদু লজ্জায় রক্তিম হয়েছিল। তার পর থেকে ওড়না পরা শুরু করে।
সেকালের বৈশাখে হিজল আর গাবগাছের এক টুকরো ছায়ায় বসে আরাম পেতাম। শুধু গ্রামে নয়, ঢাকার আজিমপুরের রাস্তার পাশেও ছিল কয়েকটি বয়স্ক গাবগাছ। বৈশাখে গ্রামগুলোর পুকুরপাড় ম-ম করত হিজল ফুলের স্নিগ্ধ সৌরভে। স্বর্ণচাঁপায় চৈত্র-বৈশাখে ফুটত সাদা ও হলুদমিশ্রিত ফুল। সে ফুলেও সুগন্ধ। তবে উৎকট নয়, হালকা ঘ্রাণ। এখন আর বৈশাখের ভাটফুল ও ব্রহ্মলতাও দেখি না। থোকা থোকা ব্রহ্মলতার ফুলের মৃদু ঘ্রাণ। স্বাধীনতার মাস তিনেক পরে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে গিয়েছিলাম তাঁর কাপাসিয়ার গ্রামের বাড়িতে। ওই এলাকায় ছিল তখন অসংখ্য পারিজাত। পথে যেতে যেতে দেখি, পারিজাতের ডালগুলোতে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আসলে আগুন নয়, রক্তের চেয়ে লাল ফুল। পারিজাতের ফুলের রং সীমাহীন লাল। সেকালে শ্রীপুর, কাপাসিয়া এলাকায় প্রচুর পারিজাত, শিমুল, পলাশ, কাঞ্চনগাছ ছিল। ওগুলো সবই বৈশাখী ফুলের গাছ।
বৈশাখী গরমে মানুষের তেষ্টা পায় বেশি। সে তেষ্টা মেটানোর ব্যবস্থাও বাঙালি করেছে। শীতের সকালে ঘোষেরা কাঁচা দুধের মাঠা-মাখন নিয়ে বের হতেন। বৈশাখে ঘোষেরা বানাতেন পাতলা দুধের ঘোল। বৈশাখী গরমে ঘোলের চাহিদা ছিল খুব বেশি। হাটবাজারে ও গ্রামের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তাঁরা ঘোল বিক্রি করতেন। এক চিমটি নুন দেওয়া এক গেলাস ঘোল এতই সস্তা ছিল যে তা এখনকার যুবক-যুবতীর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। খুব বড় এক গেলাস ঘোল চার পয়সা। ওই দর স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ছিল।
বাংলা নববর্ষের প্রধান বিষয় বৈশাখী মেলা ও হালখাতা। মেলা বলতে আমি যা বুঝি, তা হলো মিলন, এলাকার পরিচিত-অপরিচিত সব মানুষের সম্মিলন। বৈশাখী মেলা হলো মিলনমেলা। তবে বৈশাখী মেলার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিরাট। তাতে গ্রামীণ বাঙালির মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পায়। কাঠ, বাঁশ, বেত, শোলা ও মাটির তৈরি কুটিরশিল্পে বাঙালির সৃষ্টিশীলতার যে প্রকাশ, তা বিস্ময়কর। শত শত বছর ধরে গ্রামের মানুষের তৈরি চারু ও কারুশিল্প বৈশাখী মেলায় বিকিকিনি হয়। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর তার প্রভাব অসামান্য। বৈশাখী মেলায় যেসব খাদ্যদ্রব্য বেচাকেনা হয়, তারও বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
আজ নগর, বিশেষ করে নগরের উচ্চবিত্ত শ্রেণিটি সবকিছু গ্রাস করতে চাইছে। গত কয়েক দিন যাবৎ পাড়ায় পাড়ায়, বাড়ি বাড়ি লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে, বৈশাখী মেলার বিজ্ঞাপন। একটি প্রচারপত্র ট্রাফিক সিগন্যালে আমার হাতেও ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, অমুক জায়গায় চার দিনব্যাপী ‘বিশাল ইন্ডিয়ান জুয়েলারি ও বৈশাখী মেলা’। তাতে পাওয়া যাবে ‘আন্তর্জাতিক বাজারে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি জুয়েলারি পণ্য—ডায়মন্ড কাট ঝুমকি, ডায়মন্ড কাট কানের দুল, ডায়মন্ড কাট প্যান্ডেন্ট সেট, মাইক্রো গোল্ড প্লেটেড লকেট সেট, গোল্ড প্লেটেড ফিঙ্গার রিং, কাশ্মীরি ঝুমকা, অ্যান্টি-অক্সিডাইজড কানের দুল, বোম্বাই গোল্ড প্লেটিং বাঙ্গলস’ প্রভৃতি। আমার অলংকার শিল্পী, তাঁতশিল্পী, কামার, কুমার ভাতে মরবেন।
কে বলে যে পশ্চিম দেশীয়রা ব্যবসা-বাণিজ্যে পাকা। একশ্রেণির বাঙালি ব্যবসাবুদ্ধিতে পাকাতর। বাংলা নববর্ষে পান্তা-ইলিশ খামাখা চালু হয়নি আশির দশকে। গরিবে তো নয়ই, নিম্নমধ্যবিত্তও ভরা মৌসুমে ইলিশ মাছ খেতে পারে না। মৌসুমে যে ইলিশটির দাম পাঁচ শ টাকা। পয়লা বৈশাখের আগে সেটির দাম হাঁকে আড়াই হাজার টাকা। গত হপ্তায় এক ব্যক্তি আমাকে জানালেন এক ব্যবসায়ী রাজনীতিকের বৈশাখী ইলিশ ব্যবসার কথা। মৌসুমে তিনি তাঁর নিজের কোল্ডস্টোরেজে হাজার হাজার ইলিশ কিনে রেখেছিলেন। এখন বাজারে ছাড়বেন। ভোটারবিহীন নির্বাচনে জিততে যতটা টাকা খরচা হয়েছিল, তার কয়েক গুণ উঠে যাবে পান্তা-ইলিশের কল্যাণে। মৎস্যজীবীরা এক বেলা অনাহারে কাটান আর বাংলার জনপ্রতিনিধিরা রাতারাতি বনে যান রকেফেলার বা বিল গেটস। স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী বাঙালি উচ্চমধ্য শ্রেণি আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না। যখন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ, তখন পান্তা-ইলিশ উৎসব! মৎস্য অধিদপ্তর মার্চ-এপ্রিল দুই মাস ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। জাতির অর্থনীতির স্বার্থের চেয়ে অধিপতি শ্রেণির স্বার্থ বড়।
বাঙালি হওয়াটাই আমাদের জন্য আবশ্যক, তবে প্রতি দশকে বা সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা বাঙালিতর হই, তাতে আসল বাঙালিত্ব হারিয়ে যাবে। হাজার বছর ধরে বাঙালি ও সংখ্যালঘু নৃজাতির মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য করে উৎসব ও পরব পালন করে আসছে। চৈত্রসংক্রান্তি বা চৈত্রপরব এবং নববর্ষ বরণের একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে হাজার বছরে। সেই জিনিসটিকে তছনছ করা ঘোরতর অন্যায়।
৪০ বছর আগেও পল্লির হাটবাজারে বা বটতলায় চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলা বসত। মেলার আনন্দ ও আমেজটা আজ আর নেই। কারুশিল্পী ও লোকশিল্পীরা জীবিকার জন্য অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। একবার এক মেলায় গিয়ে দেখি এক লোকশিল্পী বাঁশের বাখারি ও রঙিন কাগজ দিয়ে এক মস্ত ঘোড়া বানিয়েছেন। তাতে চড়ে তিনি গাইছেন, আমি টুকে এনেছিলাম: ‘হেকমত আলি নামটি আমার রাইখাছেন বাপজান/ হেকমতের জোরে আমি সওয়ার করি যান।’ বাংলার নিম্নবর্গের মানুষকে বিধাতা যথেষ্ট হেকমত দিয়েছেন। সেই হেকমত বিকাশের সুযোগ যদি রাষ্ট্র করে দিত, আমাদের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হতো। ভণ্ড, পদলেহী ও সুবিধাভোগী নাগরিক ভদ্রলোকদের সঙ্গে গ্রামীণ জ্ঞানীদের তফাত বিরাট। তাঁরা তাঁদের ভাব ও ভাষা কারও থেকে ধার বা চুরি করেন না। পল্লিকবিদের ভাব অন্তর থেকে উৎসারিত।
চৈত্রপরব ও বৈশাখী মেলা উৎসব একেবারেই গ্রামীণ মানুষের উৎসব। বাংলা নববর্ষ নিয়ে বহুদিন যাবৎ যাঁরা রচনা লেখেন, তাঁরা অবধারিতভাবে আকবর বাদশাহর উল্লেখ করেন। এখন দেখছি কোনো কোনো প্রসিদ্ধ লেখক বলছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা নববর্ষ সমার্থক’। কোমলমতি অনেকের মনে হবে কবিগুরুর আগে নববর্ষ বলে কিছু ছিল না। বিশ্বকবির সঙ্গে বৈশাখের সম্পর্ক এইটুকু যে তিনি অন্য কোনো মাসে নয়, বৈশাখে জন্মগ্রহণ করেছেন; যেমন নজরুল আষাঢ়-শ্রাবণে নয়, জ্যৈষ্ঠে ভূমিষ্ঠ হন।
মধ্যযুগ থেকেই বাংলার কবিরা বাংলা নববর্ষকে করেছেন তাঁদের কবিতার উপজীব্য। বাংলাদেশের একজন প্রধান কবি ভাওয়ালের গোবিন্দচন্দ্র দাস। ১৩০ বছর আগে ‘নববর্ষ ১২৯১’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলেন:
এস বর্ষ! আশাপূর্ণ হৃদয়ে তোমায়
প্রীতিপূর্ণ প্রাণে করি শুভ আবাহন,
কাতরে কাকুতি করি, করুণা কৃপায়
প্রাণের একটি আশা করিও পূরণ।

এক স্বার্থে পরস্পর না হলে জড়িত,
এক দুঃখে না করিলে ব্যথা অনুভব,
এক কার্যে না হইলে চিত্ত উৎসারিত,
অমর-অদৃষ্টে ঘটে অনন্ত রৌরব।

দেও বর্ষ ভক্তি শিক্ষা জন্মভূমি প্রতি;
ভ্রাতৃভাবে সকলেরে কর সম্মিলিত,
দ্বেষ হিংসা পরস্পর ঈর্ষা পাপমতি,
মনের মালিন্য যত কর প্রক্ষালিত।
রৌরব নরক হলো মুসলমানদের যা জাহান্নাম। বেশি হিংসা-বিদ্বেষ নিয়ে থাকলে দেশের এক ধর্মের লোক যাবে রৌরব নরকে, আরেক ধর্মের লোক যাবে জাহান্নামে। প্রিয় জন্মভূমিতে আমরা তা হতে দিতে পারি না। আগের বছরের হিংসা-বিদ্বেষ-মিথ্যাচার এবং প্রতিপক্ষ সম্পর্কে অপবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকার শপথ নেওয়ার দিন পয়লা বৈশাখ। কলহ ও শত্রুতা কোনো স্থায়ী ব্যাপার নয়, স্থায়ী হলো সহমর্মিতা, সহ-অবস্থান ও ভ্রাতৃভাব। সেটাই নববর্ষের শিক্ষা ও দর্শন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.