নেতাদের ঐক্য কর্মী পর্যন্ত পৌঁছাবে তো? by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

নাগরিক কমিটি বা উন্নয়ন আন্দোলন ইত্যাদি নাম ব্যবহার করা হচ্ছে বটে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন যে আসলে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাই, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। প্রার্থী বা সমর্থকদের বক্তব্যেও তেমন রাখঢাকের বালাই নেই। চট্টগ্রামে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থীসহ আরও যে নয়জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কজন প্রত্যাহার করবেন বা প্রার্থিতা অব্যাহত রাখবেন, সেই হিসাবে না গিয়ে এখনই বলে দেওয়া যায়, মেয়র পদের লড়াইটি হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই।
বড় দুই দলে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন বেশ কজন। দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির এবং কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে সদ্যবিদায়ী মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমকে পুনর্বার প্রার্থী করা হবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধা-সংশয় ছিল। ডা. শাহাদাত হোসেনকে চেয়েছিলেন কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। কেন্দ্র থেকে আমীর খসরু মাহমুদকে প্রার্থী করার আগ্রহ দেখানো হয়েছিল বলে শোনা যায়। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগ নাছিরকে এবং বিএনপি মনজুরকেই বেছে নিয়েছে। বলা বাহুল্য, এই সিদ্ধান্ত বড় দুটি দলেরই একাংশের কর্মী-সমর্থকদের খুশি করতে পারেনি। এর তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়াও আমরা দেখতে পেয়েছি।
দলীয় মনোনয়নের সংবাদ শুনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে ছুটে গেছেন অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক। তাঁকে প্রার্থী হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ধরনা দিয়েছেন বাড়ির সামনে। কিন্তু তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না বলে জানালে ক্ষুব্ধ ও বিমর্ষ হয়েছেন। মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফেসবুকের মাধ্যমে তাঁর হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন।
বিএনপি থেকে মনজুর আলমকে মনোনয়ন (সমর্থন) দেওয়া হতে পারে, এমন খবর চাউর হওয়ার পর নগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী সিরাজের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা মিছিল নিয়ে গিয়েছিলেন আমীর খসরুর বাসভবনে। পাঁচলাইশ এলাকায় মনজুর আলমের কুশপুতুল দাহ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কর্মীরা। মনজুর আলম দলের আন্দোলন-সংগ্রামে কখনো ছিলেন না, তিনি আসলে দিনে বিএনপি, রাতে আওয়ামী লীগ—এসব বিষোদ্গারও করা হয়েছে তাঁর নামে।
কিন্তু দিন যত গেছে, প্রার্থী পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে ধীরে ধীরে থিতিয়ে গেছে উভয় দলের বিক্ষুব্ধ কর্মীদের প্রকাশ্য তৎপরতা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাস্তবতা মেনে নিয়েছেন তাঁরা। তবে দলীয় প্রার্থীকে মেনে নিলেও কতটা মনে নিতে পেরেছেন, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরের ওপর প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের সম্ভাবনা বা সংকট অনেকটাই নির্ভরশীল বলে মনে করি আমরা।
আ জ ম নাছির মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় তাঁর পাশে ছিলেন মহিউদ্দিন, ছালামসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা। নির্বাচন সামনে রেখে নাছিরের সংবাদ সম্মেলনে দীর্ঘদিন পর এক মঞ্চে দেখা গেছে মহানগর আওয়ামী লীগের সব নেতাকে। অথচ নতুন কমিটি হওয়ার পর থেকে পদ-পদবি নিয়ে নানা বিরোধের কারণে নগর আওয়ামী লীগের কোনো সভায় সব নেতাকে একত্রে দেখা যায়নি এর আগে। নাছিরের মনোনয়নের পরে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমিসহ অনেকেই মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সব ভেদাভেদ ভুলে নাছিরকে সমর্থন দিয়েছি। যাঁরা মনোনয়ন চেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সামান্য হতাশা থাকবে। তবে সেই হতাশা নিরসন করে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিনিয়ে আনতে হবে। আমাদের কাছে জয়ের বিকল্প নেই।’
একই রকম ঐক্যের মনোভাব দেখা গেছে বিএনপির নেতাদের মধ্যেও। মনজুর আলমের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন নোমান-খসরুসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা। চট্টগ্রাম নগর বিএনপিতে নানা সময়ে নানা মেরুকরণ দেখা গেছে আগে। নিকট অতীতে আবদুল্লাহ আল নোমানের সঙ্গে আমীর খসরুর বিরোধ যেমন বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছিল, তেমনি নগর বিএনপির সভাপতি খসরুর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেনের বিরোধও বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছে। শাহাদাতের অনুসারীরা অনেকে এখনো মনে করেন, মেয়র পদের প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন খসরু। তবে মামলা ও গ্রেপ্তারের শঙ্কার মধ্যে শাহাদাতের প্রার্থী হওয়া যে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডা. শাহাদাত বলেছেন, ‘প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ ছিল। কিন্তু আগ্রহ থাকলেও অনেক সময় অনেক কিছু হয় না। তৃণমূলের কর্মীরা চেয়েছিলেন এমন একজনকে দল সমর্থন করুক, যিনি আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন। ওই দিক থেকে তৃণমূলে ক্ষোভ আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। তবে দল যেহেতু সমর্থন দিয়েছে, তাই ক্ষোভ ভুলে দলের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করতে হবে।’ অন্যত্র শাহাদাত বলেছেন, ‘...আমি নেতা-কর্মীদের বলে দিয়েছি মেয়র পদে মনজুর আলমের পক্ষে কাজ করার জন্য। মামলাজট কাটিয়ে আমিও শিগগির তাঁর পক্ষে মাঠে নামব।’
গত ৩১ মার্চ হোটেল পেনিনসুলায় একজন মন্ত্রী, দুজন প্রতিমন্ত্রী, ছয়জন সাংসদসহ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন, মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন সেটাকে যতই ‘গেট টুগেদার’ বলে উল্লেখ করুন, তা যে আসলে নির্বাচনের কৌশল নির্ধারণী বৈঠক, তাতে কোনো সংশয় নেই। যদিও প্রার্থী আ জ ম নাছির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না, কিন্তু ‘গেট টুগেদারে’ একজন মন্ত্রী ‘যেকোনো প্রকারে হোক জিততে হবে’ ধরনের বক্তব্য দিতে পারেন কি না, তাতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয় কি না, এ প্রশ্ন উঠবেই। যা-ই হোক, এই রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা যে তাঁদের প্রার্থীর পক্ষে এককাট্টা, সেই বার্তা পাওয়া গেছে।
মনজুর আলমের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আবদুল্লাহ আল নোমানকে, প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট আমীর খসরু মাহমুদ। অন্যদিকে, নাছিরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ইসহাক মিয়া ও সদস্যসচিব মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ যেন বাঘে-মোষে এক ঘাটে পানি খাওয়া। অর্থাৎ এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দুটি দলই অন্তর্দলীয় নানা কোন্দল দূরে ঠেলে দিয়ে তাৎক্ষণিক লক্ষ্য (নির্বাচনে বিজয়) অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে নেতাদের মধ্যে যে ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তা যদি তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায়, সেটা হবে দুই দলেরই দীর্ঘমেয়াদি লাভ। এই নির্বাচনের সূত্রে দীর্ঘদিনের গ্রুপিং রাজনীতির অবসান ঘটলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে। আর যদি গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেওয়ার ছক কষতে থাকেন নেতাদের কেউ, তাতে নির্বাচনে ফলাফল বিপর্যয় শুধু নয়, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভোগ করতে হবে আরও বহু দিন।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.