ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সোয়া ৪ লাখ মানুষ কোনো ধরনের ত্রাণ পায়নি দুর্গতরা by আনোয়ার পারভেজ

শনিবারের কালবৈশাখীতে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা
হাটের এই গাছটি উপড়ে পড়ে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা
বগুড়ার ইসলামপুরের হরিগাড়ি গ্রামের নারী আসমা বেগম। ১০ মাস আগে স্বামী রফিকুল ইসলামকে হারিয়েছেন। সেই শোক না সামলাতেই গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ঝড়ে এক টুকরো টিনের বসতঘরটি হারালেন তিনি। একদিকে স্বামী হারানোর শোক, অন্যদিকে স্বামীর স্মৃতিভরা ঘরটি হারিয়ে এখন তিনি দিশেহারা। পেটে নেই খাবার, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁইও।
শুধু আসমাই নন, তাঁর মতোই অসহায়, দিশেহারা ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বগুড়ার বহু মানুষ। ওই প্রচণ্ড ঝড়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলায় ২০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। বগুড়া সদরেই মারা গেছেন সাতজন। তাঁদের তিনজন শহরতলীর পালশা এলাকার। আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন আরও অনেকে।
ঝড়ের দুই দিন পরও দুর্গত এলাকায় কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি সাহায্য পৌঁছায়নি। বসতবাড়ি লন্ডভন্ড হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়া মানুষের পাশে কেউ দাঁড়াননি। দু-একজন সাংসদ খোঁজখবর নিয়েছেন; এটুকুই।
এদিকে গতকাল তৃতীয় দিনেও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়ায় নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শহরবাসীকে। বিদ্যুতের অভাবে হাসপাতাল, সরকারি কলেজের ছাত্রীনিবাসগুলোতে দেখা দিয়েছে পানির সংকট। গতকাল সরেজমিনে দুর্গত এলাকার এমনই দুর্ভোগ-দুর্দশার দেখা মিলেছে।
পালশা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বহু বাড়ির টিনের চালা নেই। অনেক বাড়ি ধ্বংসস্তূপ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। অর্ধশতাধিক বিদ্যুতের খুঁটিও ভেঙে গেছে। উপড়ে আছে দুই শতাধিক গাছ। লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি মেরামতের চেষ্টা করছেন। অনেকেই ধ্বংসস্তূপে সর্বস্ব চাপা পড়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে কাটাচ্ছেন।
দুপুরে আসমা নামের এক নারী বললেন, ‘অন্যের বাড়িত কাজ করি। স্বামীর ঘর ছাড়া মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। ঘরে নবম শ্রেণিপড়ুয়া এক কন্যা। দুই দিন ধরে ঘর মেরামতের টাকার জন্য পাগলের মতো মানুষের কাছে হাত পেতেছি। কোনো জনপ্রতিনিধি এক টাকা দিয়েও সাহায্য করেননি। প্রতিবেশী কয়েকজন মিলে আড়াই হাজার টাকা সাহায্য দিয়েছে। রাজু নামে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের একজন সুইপার দিয়েছেন দেড় হাজার টাকা। এই টাকায় টিন কিনে বাড়ি ফিরছি।’
মধ্যপালশা পাকা সড়কের পাশে বিধ্বস্ত টিনের ঘরের পাশে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন দুই বোন মাসুদা বেগম ও হাওয়া বেগম। মাসুদার স্বামী দিনমজুর। হাওয়া স্বামীহারা। মাসুদা বলেন, ‘অন্যের বাসাবাড়িতে দুই বোন কাজ করি। ছয় শ টাকায় দুটো ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। আমার
সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া দুই মেয়ে। বোনের ঘরে স্কুলপড়ুয়া এক মেয়ে। ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়েছে ঘরের ওপর। আসবাবপত্র, রান্নার জিনিসপত্র সবকিছুই চাপা পড়েছে।’
হাওয়া বেগম বলেন, ‘তিন দিন ধরে ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে অনাহারে। রান্নার হাঁড়ি নেই। পরনের কাপড় থেকে চাল-লবণ, সব ওই চাপা পড়া ঘরের ভেতর। বাচ্চাদের কষ্ট দেখে একজন ১০০ টাকা দিয়েছেন। সেটা দিয়ে চিড়া-গুড় খেয়ে বেঁচে আছি।’
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন দিনে কোনো জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কর্মকর্তা দুর্গত এলাকায় যাননি। ২০ জন মানুষ মারা যাওয়ার পরও জেলার সাত সাংসদের বেশির ভাগ এলাকায় অনুপস্থিত। বগুড়া সদরে প্রাণহানি বেশি ঘটলেও এখানকার সাংসদ নুরুল ইসলাম ওমরও ঢাকায় রয়েছেন।
সাংসদ ও প্রশাসনের ভাষ্য: সাংসদ নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় থেকে তো লাভ নেই। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাশে খালি হাতে দাঁড়ানো যায় না। এলাকায় গেলেই লোকজন সাহায্য চাইবে। সাহায্য তো আর বগুড়ায় বসে থেকে এমনি এমনি মিলবে না। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের বরাদ্দের জন্যই মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছি। কিছু ব্যবস্থা করি, তারপর এলাকায় যাব।’
জেলা প্রশাসক শফিকুর রেজা বিশ্বাস বলেন, নিহত পরিবারের জন্য নগদ পাঁচ লাখ টাকা ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বগুড়া শহর বা পৌর এলাকায় এ মুহূর্তে কোনো সাহায্য দেওয়া সম্ভব না হলেও গৃহনির্মাণ সহায়তার তালিকায় ক্ষতিগ্রস্তদের নাম অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সরকারি সহযোগিতা দেওয়া হবে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাকিল মাহমুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচ মেট্রিক টন চালের বরাদ্দ পেয়েছি। তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। মঙ্গলবার থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিতরণ করতে পারব বলে আশা রাখি।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. খোরশেদ আলম বলেন, ঝড়ে ৯২ হাজার পরিবারের ৪ লাখ ১৭ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ২৮ হাজার ৬৬৭টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ও ৭০ হাজার বাড়িঘর এবং ২৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন আহতরা: ঝড়ে সরকারি হিসাবেই আহত ব্যক্তির সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁদের অধিকাংশই চিকিৎসাধীন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বেলা ১১টার দিকে জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, অনেকে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছেন। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন।
যন্ত্রণাকাতর এ রকমই একজন সদরের কইচর গ্রামের বৃদ্ধ কৃষক আমজাদ হোসেন। পুকুরে মাছের খাবার দিতে বের হয়েছিলেন তিনি। ঝড় শুরুর আগেই পা বাড়ান বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়িতে পৌঁছার আগেই ঝড়ে গাছের নিচে চাপা পড়েন। এরপর চেতনা হারান।
সদরের অন্তাহার গ্রামের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সিয়াম মুঠোফোনে ফ্লেক্সিলোড করতে গিয়েছিল বাজারে। ঝড় শুরু হলে একটি প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়ালে সেটি ভেঙে নিচে চাপা পড়ে সে। লোকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এখনো ভয়ে আঁতকে উঠছে সে। গোটা শরীর তার ব্যান্ডেজে মোড়া।
হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা বলেন, ঝড়ের পর থেকে এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে ৭১ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।
বিদ্যুৎ নেই, দুর্ভোগ: ঝড়ের এক দিন পর রোববার রাত থেকে শহরের কিছু এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও সিংহভাগ এলাকা রয়েছে বিদ্যুৎবিহীন। এসব এলাকায় পানি-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সরকারি আজিজুল হক কলেজের একমাত্র ছাত্রীনিবাস বেগম রোকেয়া হলের ছাত্রী বৃষ্টি খন্দকার বলেন, ‘তিন শ আসনের এ হলে ছয় শতাধিক ছাত্রীর বাস। তিন দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। গরমে কক্ষে টেকা যায় না। ঝড়ের পর থেকেই পানি নেই। গোসল-খাওয়া সব বন্ধ।’

No comments

Powered by Blogger.