বিষয় ক্রিকেট by আবুল হায়াত

ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট খেলতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও মাঠে গিয়ে প্রায়ই ক্রিকেট খেলেছি। নিজেকে আমি মোটামুটি ক্রিকেটার বলতে পারি। শুধু ক্রিকেটার বললে ভুল হবে—অলরাউন্ড ক্রিকেটার বলতে হবে। কারণ ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং—সবই করতাম। অবশ্য সবই খুব বাজে মানের ছিল, শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারিং করে অবসর নিয়ে ফেলি। সেখানেও বাজে আম্পায়ারিংয়ের অভিযোগ ছিল আমার বিরুদ্ধে।
তাতেও অবসর হয়নি। কারণ, এখনো আমি ক্রিকেটের শ্রোতা ও দর্শক। রাত-দিন যখনই ক্রিকেট খেলা হয়, আমি আছি। হয় রেডিওতে, নয় টিভিতে। সেটা সম্ভব না হলে ইন্টারনেটে।
ক্রিকেট আজ একটি জাতীয় আলোচনার বিষয়। আমরা সদ্য একটি বিশ্বকাপ খেলে এসেছি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে। আমাদের ছেলেরা এবারেই সবচেয়ে ভালো খেলা প্রদর্শন করেছে। কাপ পাব না জেনেও আমরা ভারতের সঙ্গে খেলাটা জিততে চেয়েছিলাম। খেলাতে জিততে কে না চায়। ভালোই খেলছিল ছেলেরা। তারপর কী ঘটল তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই আশা করি। আশাহত আমরা। ক্ষুব্ধ পুরো জাতি।
আমার ক্রিকেটভক্তির কারণে আমার স্ত্রী শিরীন আগে প্রায়ই বিরক্ত হতো। রেডিও কেড়ে নিত, টিভি বন্ধ করে দিত, আবার কখনো বলত—থাক, কী বলত সেটা নাহয় না-ই শুনলেন। আসল কথাটা বলি।
সে এখন ক্রিকেটভক্ত। বাংলাদেশ যখন থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিচ্ছে তখন থেকেই ক্রমেই বাড়ছে তার আগ্রহ। এবং এখন সে নিজে নিজেই আমার অনুপস্থিতিতেও ক্রিকেট দেখে। উপলব্ধি করে এর অন্তঃস্থ মজাটা। সেদিন রুবেলের নো বল এবং মাহমুদউল্লাহর আউটের পর সে যদি ইয়ান গোল্ড আর আলিম দারকে হাতের কাছে পেত, খোদা জানেন, কী করে ফেলত! আর শ্রীনিবাসন নামটা তো এখন তার কাছে সাক্ষাৎ শয়তান।
ক্রিকেটে চুরি-চামারি নতুন কিছু নয়। খেলাটা শুরুর সময় থেকেই চলে আসছে জেতার জন্য নানা ছলচাতুরী। এ ক্ষেত্রে আম্পায়ারের অবদানটাই মুখ্য। তাঁদের উৎকোচ দিয়েই এ কাজ সাধিত হতো। এবং এখনো হয় বোধ হয়।
খেলাটার মূল রয়েছে ইউরোপে। কেউ বলেন হল্যান্ড এর জন্মদাতা। কোথায় যেন পড়েছিলাম চীনই প্রথম ক্রিকেট খেলে। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সূত্র বলে, খেলাটা আবিষ্কৃত হয় ষোড়শ শতকে গ্রেট ব্রিটেনের সাসেক্সে। বাচ্চাদের খেলা হিসেবেই এর উৎপত্তি। অনেকটা ডান্ডাগুলি খেলা আরকি। একটা গোলাকার (পাথর কিংবা কাঠের) বস্তুকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দূর করা ছিল এই খেলার মূল লক্ষ্য। পরে বয়স্করাও মজা পেয়ে খেলা শুরু করেন ক্রিকেট। ১৬১১ সালে মজার ঘটনাও ঘটে এই খেলা নিয়ে। দুই ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা হয়, রোববার চার্চে প্রার্থনায় না গিয়ে ক্রিকেট খেলার অপরাধে। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় ১৮৪৪ সালে আর ১৮৭৭ সালে শুরু হয় টেস্ট ম্যাচ। ক্রমে ক্রমে নানা ফর্ম এসেছে: এক দিনের খেলা, সিক্স-এ সাইড, সিঙ্গেল উইকেট, টি-টোয়েন্টি ইত্যাদি। পাঁচ দিনের টেস্ট খেলায় ঝিমানো ভাব চলে আসায় তৈরি করা হয় এসব দর্শক-উদ্দীপক ফর্ম।
ভারত উপমহাদেশে ১৭৩৭ সাল থেকে চালু হয় ক্রিকেট, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বদৌলতে। তারা গড়ে তোলে শহর মাদ্রাজ, মুম্বাই, কলকাতা। এই স্থানগুলোতেই গড়ে ওঠে ক্রিকেট ক্লাব। প্রথম শ্রেণির প্রথম ম্যাচ হয়, কলকাতা-মাদ্রাজ, ১৮৬৪ সালে। খেলাটা কোথায় হয়েছিল, জানা নেই অবশ্য আমার।
ক্রমেই ঢাকায়ও বিস্তারিত হয় ক্রিকেট। সেদিন কোথায় যেন পড়লাম, আমির খানের লগন সিনেমার কাহিনিটি বাস্তবে ঘটেছিল আমাদের ঢাকায়। ব্রিটিশ টিমকে হারিয়েছিল ঢাকার ছেলেরা। পর পর দুই বিশ্বকাপে আমরা আবার তা করে দেখিয়েছি।
ও হ্যাঁ, ফিরে আসি চুরি–চামারির ব্যাপারে। তার আগে দুটো চুটকি হয়ে যাক না!
এক মহিলা ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়েছেন। তিনি খেলাটা বোঝেন না। একজন আউট হতেই সবাই হর্ষধ্বনি করে ওঠে। উনি পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী হলো ভাই?’
‘এখনই একজন এলবি হয়ে গেল।’
‘ও তাই? ক্যাচটা কে নিল?’
তখন নিউজিল্যান্ড সবচেয়ে দুর্বল ছিল। একবার টেস্টে ২৬ রানে অলআউট হয়েছিল। প্রথম ব্যক্তি: একজন দর্শক ক্রিকেট খেলার সময় বাথরুমে গেলে কী হারাবেন? দ্বিতীয় ব্যক্তি: পুরো নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিংটাই মিস করবে।
সেদিন ফেসবুকে দেখলাম, নুডলস রান্না শেখাচ্ছে। তামিম ইকবাল ব্যাটিংয়ে নামলেই চুলায় চাপাবেন আর আউট হলেই নামিয়ে ফেলবেন। তাহলেই নুডলস তৈরি।
আবার যেদিন ভালো খেলল তামিম, সেদিন স্ট্যাটাস দেখলাম, আজ যাঁরা নুডলস রান্না করেছেন, সবারটাই পুড়ে গেছে।
হ্যাঁ, এবার চুরির ঘটনায় আসা যাক।
একেবারে পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে পাকিস্তানে আসে এমসিসি (ইংল্যান্ড) দল। আম্পায়ার সেবার ঝাঁকে ঝাঁকে ব্রিটিশদের আউট দেয়। পায়ে লাগলেই এলবি। খেপে গিয়ে এক রাতে আম্পায়ারকে রুম থেকে তুলে নিয়ে মদের বালতিতে চুবিয়েছিল ইংলিশ খেলোয়াড়েরা।
সত্তরের দশকে কলকাতায় পাকিস্তান জিতছিল প্রায়। বৃষ্টিতে ঝামেলা হচ্ছিল সেদিন। সেই সুযোগে আম্পায়ার গাঙ্গুলী দিলেন খেলা বন্ধ করে, আইন ভঙ্গ করে। তখনো ডিএল মেথড চালু হয়নি, বেঁচে যায় ভারত পরাজয় থেকে।
নিউজিল্যান্ডে খেলা হচ্ছে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। নিউজিল্যান্ডের আম্পায়ার কোনো আউটই দিচ্ছিলেন না। ইংলিশ খেলোয়াড়েরা ত্যক্ত-বিরক্ত। এ সময় একজন হলেন সরাসরি বোল্ড। ইংলিশ প্লেয়ার আম্পায়ারের কাছে এসে বলেন: হাউ ইজ দ্যাট?
আম্পায়ার: সে বোল্ড হয়েছে।
ইংলিশ প্লেয়ার: বোল্ড হয়েছে তা তো দেখছি, আউট হয়েছে কি?
ক্রিকেটে প্রচুর আইন রয়েছে নিয়ন্ত্রণের জন্য। প্রথমতই বলা হয়, এটা ভদ্রলোকের খেলা, ভদ্রতা মানিয়ে চলতে হবে। নট টু রিজন হোয়াই, বাট টু ডু অর ডাই। এদিক-ওদিক কিছু হলেই আপনাকে আইন দেখানো হবে।
খেলায় আম্পায়ার স্বাগতিক দলের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করছিলেন, বিরোধী ক্যাপ্টেন অবশেষে আম্পায়ারের কাছে গিয়ে বলেন, খুবই ভদ্র ভঙ্গিতে: স্যার, আইসিসিতে চিন্তা করার ব্যাপারে কোনো আইন আছে কি?
আম্পায়ার: না। কেন, আপনি কি কিছু চিন্তা করছেন?
ক্যাপ্টেন: জি। আমরা মানে আমার দল, আমি নিশ্চিত আমার গোটা জাতি চিন্তা করছে আপনি একটা চোর!
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে আন্তরিক অভিনন্দন।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.