জলাবদ্ধতার বৃত্তে ‘বন্দী’ চট্টগ্রাম

সিডিএ অ্যাভিনিউ। চট্টগ্রাম নগরের মূল সড়ক এটি।
গতকাল বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় সড়কের মুরাদপুর এলাকা।
ছবিটি বেলা একটায় তোলা l সৌরভ দাশ
কোথাও হাঁটুসমান পানি, কোথাও বা বুকসমান। গতকাল সোমবার চট্টগ্রাম নগরের চিত্র ছিল এমনই। সকাল থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে সরু গলি থেকে রাজপথ হয়ে পড়ে জলাবদ্ধ। সেই সঙ্গে দিনভর তীব্র যানজট ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছে মানুষের।
প্রবল বৃষ্টিতে নগরের চকবাজার, কাপাসগোলা ও চাক্তাই এলাকায় বেশ কিছু বিপণিবিতান ও বাসার নিচতলায় পানি ঢুকেছে। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের। আবহাওয়া দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১০৬ দশমিক ৬ মিলিমিটার। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (সন্ধ্যা সাতটা) থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন তিনজন।
তবে বৃষ্টিতে নগর জলাবদ্ধ হলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এর দায় চাপাচ্ছে নগরবাসীর ওপর। বেশির ভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলেও করপোরেশন এ অবস্থাকে জলজট বলছে। সিটি করপোরেশনের সচিব রশিদ আহমদ মুঠোফোনে গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরের সব খাল-নালা নিয়মিত খনন করা হয়। কিন্তু খননের কিছুদিন পরেই লোকজন সেখানে ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন নিক্ষেপ করে। এতে পানিনিষ্কাশন-প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে। আর আজ (গতকাল) যা হয়েছে, তা জলাবদ্ধতা নয়, জলজট।’
বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার সুযোগে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকেন অটোরিকশা ও রিকশাচালকেরা। যাত্রীদের কাছে ২০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। আবার বাড়তি ভাড়া দিতে চেয়েও অনেককে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সড়কে জমে থাকা পানিতে বিকল হয়ে যায় অনেক যানবাহন। বিকেলের পর নগরে বাস, টেম্পো, রাইডারসহ অন্য যানবাহন চলাচল কমে যায়। এতে অফিস-ফেরত মানুষ দুর্ভোগের শিকার হন।
নগরের এনায়েতবাজার এলাকায় দুপুরে কথা হয় এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো. ইশতিয়াকের সঙ্গে। সকালে চকবাজার এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা না পেয়ে অনেকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। অনেকটা পথ হেঁটে রিকশা পেলেও প্রবল বৃষ্টির কারণে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছানোর আগেই জামাকাপড় ভিজে যায় তার। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার জন্য কোনো যানবাহনও পাচ্ছে না ইশতিয়াক।
মো. আলমগীর নামে এক সিএনজি অটোরিকশাচালক বলেন, ‘যেদিকে যাই, সেদিকেই যানজট আর পানি। কীভাবে গাড়ি চালাব? নিউ মার্কেট থেকে প্রবর্তক যেতে এক ঘণ্টা লেগেছে।’ স্বাভাবিক অবস্থায় ওই দূরত্ব যেতে ২০ মিনিট লাগে।
নগরের মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, কাপাসগোলা, বাকলিয়া, ডিসি রোড, আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, নয়াবাজার, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, শুলকবহর, চকবাজার, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, প্রবর্তক মোড়, নাসিরাবাদ, মোহরা, বহদ্দারহাট, পাঁচলাইশসহ নগরের বিভিন্ন এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে যায়।
দুপুরে ষোলশহর ও মুরাদপুর এলাকায় সড়কের দুই পাশে কয়েক শ যানবাহন আটকা পড়ে। উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে এবার এ এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি হয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, মুরাদপুর ও ষোলশহর এলাকায় প্রতি বর্ষায় পানি ওঠে। কিন্তু বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গে পানি নেমে যায়। এবার ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হওয়ায় সড়ক অনেকটা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নালা-নর্দমাও ভরাট হয়ে গেছে। ফলে দ্রুত পানি নামতে পারেনি।
জলাবদ্ধতার কারণে নগরের প্রবর্তক মোড়, মেহেদিবাগ, মুরাদপুর, ষোলশহর, বহদ্দারহাট ও আগ্রাবাদ সড়কে যানজট দেখা দেয়। মেহেদিবাগ-চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সড়কে অন্তত এক ঘণ্টা ধরে যানবাহন চলাচল স্থবির ছিল। পানির কারণে প্রবর্তক মোড় অতিক্রম করতে না পারায় বিকেলের দিকে ওই সড়কে শত শত গাড়ি এক জায়গায় স্থবির হয়ে ছিল।
পতেঙ্গা আবহাওয়া দপ্তরের আবহাওয়াবিদ নিলুফার জাহান জানান, সাধারণত চৈত্র মাসে এ ধরনের ভারি বৃষ্টি হয় না। মে মাসের দিকে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হলে ভারী বৃষ্টিপাত হয়। লঘুচাপের বর্ধিতাংশের প্রভাবে এ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যখন পশ্চিম দিকে কোনো লঘুচাপ হয় তখন তার বর্ধিতাংশের প্রভাবে বাংলাদেশ উপকূলে বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টি হয়।
দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রবৃষ্টির কারণে আসকারদিঘির পাড়, জামালখান, আন্দরকিল্লা, পাঁচলাইশসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ রাখে বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, ঝড়-বৃষ্টি হলে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ-সংযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। গতকাল বেশ কিছু এলাকায় সকালে ও বিকেলে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে তা আবার চালু করা হয়।
বৃষ্টি হলেই কেন জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম—এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি জেরিনা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জনগণ—কারও মধ্যে টেকসই নগর গড়ার চিন্তা নেই। নগরে পানি ধারণ ও নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাই অতিবৃষ্টি হলেই নগরে পানি জমে যায়।
বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতে নগরের ফিশারিঘাটে দুজন ও বোয়ালখালীতে একজন নিহত হয়েছেন। ফিশারিঘাট এলাকায় বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন মো. কবির হোসেন (৩০) ও মো. মফিজ আলম (২৬)। দুজনের বাড়িই কক্সবাজারের মহেশখালীতে।
মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম জানান, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বৃষ্টির মধ্যে ফিশারিঘাট ১ নম্বর জেটিতে কয়েকজন মৎস্যজীবী জাল পরিষ্কার করার সময় হঠাৎ বজ্রপাত হয়। এতে চারজন গুরুতর আহত হন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তাঁদের হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসক কবির ও মফিজকে মৃত ঘোষণা করেন।
বোয়ালখালীতে বজ্রপাতে মারা গেছেন আরও একজন। নিহত আবদুল হালিম (৪২) নামে অপর একজন। নিহত আবদুল হালিম বোয়ালখালী মধ্যম চরণদ্বীপ হাজিপাড়ার মৃত দেলা মিয়ার ছেলে। বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শামসুল ইসলাম জানান, বেলা একটার দিকে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ফসলের খেতে কাজ করছিলেন আবদুল হালিম। ওই সময় বজ্রপাতের শিকার হয়ে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

No comments

Powered by Blogger.