জেতার নয়, হারানোর নির্বাচন by সোহরাব হাসান

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রার্থী ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তাপ বাড়ছে। প্রতিদিন প্রার্থীদের পারস্পরিক দোষারোপ, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের পাশাপাশি অঘটনের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। নির্বাচন কমিশন তথা রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে একের পর এক নালিশ আসছে। সাধ্যমতো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারি দলের প্রার্থীরা অভিযোগ করলে যেভাবে ত্বরিত গতিতে প্রতিকার হয়, বিরোধী দলের প্রার্থীদের বেলায় তা ঘটে না।
গত তিন দিনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান ঘুরে যে জিনিসটি লক্ষ করলাম, তা হলো নির্বাচন নিয়ে নগরবাসীর একধরনের নিস্পৃহতা। অফিসে, রেস্তোরাঁয় কিংবা পেশাজীবীদের আড্ডায় নির্বাচন নিয়ে যাঁদের সঙ্গেই আলাপ করেছি, তাঁরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে বলেছেন, ইতিমধ্যে যেসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সংশয় আছে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও চট্টগ্রামবাসী তার সুবিধা পাবে কি না? অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। কেউ সিটি নির্বাচনের বিজয়কে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করতেও দ্বিধা করেননি। কেউ ‘দুই কুল’ রক্ষা করতে গিয়ে সিটি করপোরেশনকেই অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। চট্টগ্রামবাসী নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
১৫ এপ্রিল সকালে বিএনপি জোটের ‘অবরোধ’ আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে যখন চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছায়, চারদিকের পরিবেশ ছিল নিরুত্তাপ, থমথমে। ১৩ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেছেন, ‘দেশের কোথাও অবরোধ নেই। আমরা এখন নির্বাচনে আছি।’ পরদিন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তাঁরা সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
সে ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি, বিএনপি আন্দোলনেও আছে, নির্বাচনেও আছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আন্দোলনে থাকাটা অন্যায় নয়। অন্যায় হলো সেই আন্দোলনকে ঘিরে যদি মহাপ্রলয় ঘটে, যদি জনগণের জানমালের ক্ষতি হয়। আমাদের অতি বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা আন্দোলন করতে গিয়ে সম্ভবত দেশের ও জনগণের ক্ষতির কথাটি ভাবেন না। সে কারণেই একজন হরতালে রেকর্ড সৃষ্টি করেন, আরেকজন অবরোধে।
বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন না করলেও স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর নির্বাচনে ঠিকই অংশ নিচ্ছে এবং এর আগে অনুষ্ঠিত বেশির ভাগ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তারা জয়ী হয়েছে। এটি ভালো দিক। তবে এটাও অস্বীকার করার জো নেই যে বাংলাদেশে পূর্বাপর সরকারের আমলে জাতীয় নির্বাচনগুলো যতটা ‘কলঙ্কিত’ হয়েছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো ততটা কলঙ্কিত হয়নি। তাই চট্টগ্রামবাসীর উদ্বেগের বিপরীতে আশার কথা হলো, এই নির্বাচনে যেহেতু ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ নেই, সেহেতু যেকোনো মূল্যে ক্ষমতাসীনেরা নিজেদের প্রার্থীকে জয়ী করতে মরিয়া হয়ে না-ও উঠতে পারেন। সিটি নির্বাচনে হারের চেয়ে জোর করে জয়ী হতে গেলে সরকারের বিপদ বেশি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে কোনো রকম অনিয়ম না করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানালেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ প্রতিপালিত হবে কি না, সেটি দেখার জন্য আমাদের আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। দুই পক্ষই জয়ের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত এবং দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেবে বলে আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। এসব আগাম ঘোষণা নির্বাচনী পরিবেশ ব্যাহত করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
বুধবার ভোরে দামপাড়া বাস টার্মিনাল থেকে যে রিকশায় আমি প্রবর্তকের মোড় হয়ে চট্টগ্রাম প্রথম আলো অফিসে যাই, তার চালককে জিজ্ঞেস করি, আগামী ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন হচ্ছে। কাকে ভোট দেবেন? তিনি বললেন, নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু আমি এখানকার ভোটার নই। আমার বাড়ি নোয়াখালী।
চট্টগ্রাম শহরে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনীর প্রচুর লোক থাকেন। তাঁদের কাছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের চেয়ে আকর্ষণীয় হলো জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু গত জাতীয় নির্বাচনে তাঁরা ভোট দিতে পারেননি। আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে গত তিন মাসে ১৩৪ জন মানুষ জীবন দিয়েছেন, সে খবর হয়তো এই রিকশাচালকের মতো আরও অনেকে জানেন না। আমাদের বৈরী ও বিদ্বেষক্লিষ্ট রাজনীতি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য সাধারণ মানুষকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করলেও নির্বাচনের পর তাঁদের কথা ভুলে যান। ক্ষমতার স্বাদ যে রাজনীতিকেরাই পুরোপুরি ভোগ করেন, সেটি আরও একবার প্রমাণিত হলো মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সম্পদের হিসাবে। প্রায় সব প্রার্থীর অঢেল সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে ধারদেনার অঙ্কটাও বেড়ে গেছে। ফলে আয়কর ফাঁকির এও এক কৌশল বটে। চট্টগ্রামে প্রার্থীদের সুলুকসন্ধানে দেখা গেছে, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২১৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ৭৬ জন স্কুলের গণ্ডিই পার হননি। সংরক্ষিত ১৪টি নারী কাউন্সিলর পদে যে ৬২ জন লড়ছেন, তাঁদের অর্ধেক এসএসসি পাস করেননি। এই পরিসংখ্যান এটাই ইঙ্গিত দেয় যে জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য জ্ঞানার্জন জরুরি নয়, জরুরি হলো দলীয় আনুগত্য ও ধনসম্পদ।
চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ সিটি নির্বাচন নিয়ে তেমন আগ্রহ না দেখালেও দুই দলের শীর্ষ নেতারা এটিকে নিয়েছেন বাঁচা-মরার লড়াই হিসেবে। তাই উভয় শিবিরে কমবেশি উত্তেজনা ও অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অরাজনৈতিক নির্বাচনটি শতভাগ দলীয় কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। মোহাম্মদ মনজুর আলম চট্টগ্রাম উন্নয়ন এবং আ জ ম নাছির নাগরিক কমিটির প্রার্থী হলেও দলীয় নেতৃত্ব কোনোটির কর্তৃত্ব অদলীয় ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দেয়নি। বিএনপি-সমর্থিত উন্নয়ন কমিটির প্রধান হয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান এবং সদস্যসচিব আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত নাগরিক কমিটির প্রধান হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া ও সদস্যসচিব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। এই নির্বাচনে যে নগরবাসীর সমস্যা ও সম্ভাবনার চেয়ে জাতীয় রাজনীতি গুরুত্ব পেয়েছে, তার আরেক প্রমাণ দলীয় নেতাদের নিয়ে নাগরিক কমিটি গঠন। দুই দল দুই সপ্তাহ ধরে নির্বাচনী প্রচার চালালেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেনি। কেন করেনি? এই প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, এদের প্রতি ভোটাররা ভরসা পাচ্ছেন না বলেই ইশতেহার দেননি।
আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছিরের সাফ কথা, মনজুর আলম পাঁচ বছরে সিটি করপোরেশনের মান একেবারে নিচে নামিয়ে দিয়েছেন। তিনি নগরবাসীর জন্য কোনো কাজ করেননি। অতএব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আর বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী পাল্টা আক্রমণ না করলেও তাঁর প্রধান নির্বাচনী প্রচারকেরা বলেছেন, যে ব্যক্তির নাম শুনলে মানুষ ভয় পায়, নগরবাসী কখনোই তাঁকে মেয়র পদে বসাতে পারেন না। স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করেন, এ রকম নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি বললেন, নির্বাচনে তিনিই জয়ী হবেন, যিনি প্রতিপক্ষের দুর্বলতা, ব্যর্থতা ও দোষের বিষয়টি জনগণের সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পারবেন।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ এখন চট্টগ্রামে। মন্ত্রীরা আসছেন ‘অনির্বাচনী’ কাজে, তাঁদের এই আসা-যাওয়া নিয়ে বিরোধীপক্ষ আপত্তি তুলেছে। আনুষ্ঠানিক প্রচারের শুরুতে পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এসে এক কর্মিসভায় বক্তব্য রেখে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। এরপর মন্ত্রীরা সতর্ক। চট্টগ্রামে এলেও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন না। কেন্দ্রীয় নেতারা দফায় দফায় এসে ‘পরামর্শ’ দিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির নেতারা চাইছেন, খালেদা জিয়াও নির্বাচনী প্রচারে চট্টগ্রামে আসুন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাঁর আসাকে কীভাবে নেয়, সেটাও ভাবার বিষয়। এ সময়ে তাঁর চট্টগ্রাম সফর নিয়ে কোনো অঘটন ঘটলে সেই দায় বিএনপির ওপরই বর্তাতে পারে।
প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী নাগরিক কমিটির আ জ ম নাছির ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের মোহাম্মদ মনজুর আলম এখন সারা শহর চষে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা নগর নিয়ে নিজেদের পরিকল্পনার চেয়েও বেশি বলছেন প্রতিপক্ষের ত্রুটি ও দুর্বলতার কথা। ভোটাররা বিভ্রান্ত। তাঁরা মনে করেন, এই নির্বাচনে প্রার্থীর গুণাগুণ বিচার হবে না, বরং দুই দলের জনপ্রিয়তা যাচাই হবে। তাই প্রার্থীর চেয়ে তাঁদের নেপথ্যের নায়কদেরই মাথাব্যথা বেশি। দুই দলই বলছে, এটা কেবল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি: এই নির্বাচনে বিরোধীপক্ষের প্রার্থীরা জয়ী হলে স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হবে। জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটবে। আন্দোলনের নামে ফের পেট্রলবোমার রাজনীতি শুরু হবে। বিএনপির নেতাদের ভাষ্য হলো: সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীরা জয়ী হলে দেশ থেকে গণতন্ত্র চিরদিনের জন্য নির্বাসিত হবে।
কিন্তু চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ স্থানীয় সরকার সংস্থার এই নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুকেই সামনে রাখতে কিংবা দেখতে চান। যে প্রার্থী নগরের উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন, যিনি নাগরিক সেবা নিশ্চিত করবেন, তাঁকেই তাঁরা ভোট দিতে চান। তাঁরা এমন মেয়র চান না, যিনি নির্বাচিত হয়ে নাগরিক এজেন্ডা বাদ দিয়ে দলীয় এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন কিংবা নির্বাচিত হয়ে নগরবাসীর সুযোগ–সুবিধার কথা বেমালুম ভুলে যাবেন।
চাঁদের যেমন নিজস্ব আলো নেই, তেমনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নিজ গুণে জয়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ কারণেই চট্টগ্রামের সাধারণ ভোটাররা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। এমনকি দলের কর্মী-সমর্থকেরাও মনে করেন, প্রার্থীদের কেউ নিজ গুণে জিতবেন না। তাঁরা জিতবেন প্রতিদ্বন্দ্বীর অদক্ষতা কিংবা নেতিবাচক ভাবমূর্তির জন্য। নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি জোর দিয়ে বললেন, প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যেই তিনিই জয়ী হবেন, যিনি প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলো বেশি বেশি তুলে ধরতে পারবেন। কেননা, দলের সমর্থন ছাড়া তাঁদের ব্যক্তিগত পুঁজি সামান্যই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.