সংবিধান সমুন্নত রাখতে হবে by কুলদীপ নায়ার

জোর করে হোক আর সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে হোক
পূণরায় হিন্দু বানানো হবে: RSS নেতা মোহন ভগবত
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে। যদিও তিনি সব ধর্মের জন্য প্রযোজ্য অভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছেন, তবু নানা ক্ষেত্রেই সংকীর্ণতার নোংরা দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। একমাত্র বিচার বিভাগই এই দূষণ থেকে মুক্ত রয়েছে। তথাপি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক কুরিয়ান জোসেফ যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, তা আসলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই ক্ষোভের বিস্ফোরণ।
কুরিয়ান জোসেফ যা বলেছেন, তার কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না: ‘ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব আমাদের বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে প্রাণ সঞ্চার করেছে। সারা বিশ্ব ঈর্ষাভরে আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য ও অখণ্ডতার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কঠিন সময়ে ভারতকে অবশ্যই তার এই সদ্গুণগুলো রক্ষা করতে হবে, অন্য জাতির মডেল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
যদিও আমি মনে করি, বিচারকদের সম্মেলনের দিনক্ষণ পরিবর্তন করে গুড ফ্রাইডের দিন ফেলায় কুরিয়ান জোসেফ কিছুটা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ভারতের প্রধান বিচারপতি এইচ এল দত্ত অত্যন্ত সততার সঙ্গেই বিশ্বাস করেন, দীর্ঘ ছুটির কারণে আদালতের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় তিনি এই দীর্ঘ ছুটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। ফলে গুড ফ্রাইডের দিন বিভিন্ন রাজ্যের উচ্চ আদালতের বিচারকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিনি খ্রিষ্টান বিচারক ও সম্প্রদায়ের সংবেদনশীলতা তিনি ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেননি।
আর ব্যাপারটা এমনও নয় যে গুড ফ্রাইডের দিন এই প্রথম বিচারকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু তখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে বৈষম্যের অনুভূতি এতটা প্রখর ছিল না। কিন্তু বিজেপি যেভাবে খোলাখুলি হিন্দুত্বের প্রচারণায় নেমেছে, তাতে বহুত্ববাদের আবহ অনেকাংশেই বিঘ্নিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই যে হাওয়ায় আমরা নিশ্বাস নিচ্ছি।
ভারতের জনগণ লোকসভায় বিজেপিকে চূড়ান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে, এটা সত্য। এতে বোঝা যায়, জনগণের চিন্তাধারায় কিছু পরিবর্তন এসেছে। এই জনগণই কিছুদিন আগেও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ভোট দিয়েছে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, সংবিধানের মৌল কাঠামো সর্বোচ্চ আদালত নির্ধারণ করেছেন, এটা পরিবর্তন করা যাবে না। এই কাঠামোর একটি অংশ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, এই বৈশিষ্ট্য আমাদের সংবিধানকে প্রাণ দিয়েছে।
চরমপন্থীরা আমাদের জাতিসত্তার মৌল বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনে নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে, বিচার বিভাগের কাছে এটাই সবচেয়ে অস্বস্তিকর ব্যাপার হওয়া উচিত। ঘর ওয়াপসি (পুনরায় হিন্দু হওয়া) স্লোগানটি বানানোই হয়েছে বহুত্ববাদের গোড়ায় কুড়াল মারার জন্য। আবার হরিয়ানার স্কুলের কারিকুলামে গীতা যুক্ত করা হয়েছে।
লক্ষাধিক মুসলিম ও খ্রিস্টানকে ধর্মান্তরিত করবে আরএসএস
দিল্লি, মুম্বাইয়ের নাওয়াই ও মধ্যপ্রদেশের জাবালপুরে গির্জায় হামলা চালানো হয়েছে। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে গো-মাংসে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এদিকে অনেক স্তুতিবাক্যের পর মোদি শেষমেশ গির্জায় হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু জনমনে সাধারণ ধারণা হচ্ছে, দেশে যে নরমপন্থী হিন্দুত্ব ছড়িয়ে পড়ছে, তিনি তার বিরুদ্ধে নন।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর অবস্থা আরও করুণ, কারণ সেগুলো জাতীয় পরিসরে আলোচনার বিষয়বস্তু নয়, এদের সম্বন্ধে মানুষের আকর্ষণও কম। যেকোনোভাবেই হোক, এসব রাজ্য হিন্দুত্ববাদী সংকীর্ণতার দ্বীপে পরিণত হয়েছে। অনেক মুসলিমকেই আমি বলতে শুনেছি, তারা জান আউর মাল (জীবন ও সম্পদ) সম্পর্কে ভীত।
আরএসএস নেতারা দিব্যি বহাল তবিয়তেই আছেন। এমনকি বিজেপির উদার মানুষেরাও নীরব আছেন। বিজেপি হয়তো চায় হিন্দুত্ববাদের জয়জয়কার হোক। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে তারা মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করতে চায়, এটা সংবিধানের মৌলিক বিচ্যুতি। সংবিধানমতে, আইনের চোখে সবাই সমান, এক মানুষের এক ভোট।
রাষ্ট্রীয় স্ময়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত
মোদি সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সাম্প্রদায়িক হয়ে না যায়। কারণ, তারাই বেশির ভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষ করে, বিচার বিভাগের দিকে কেউ আঙুল তুলুক, সেটা নিশ্চয়ই তারা চাইবে না। এদিকে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, ‘পাঁচ তারকা কর্মীরা’ আদালত পরিচালনা করছেন, এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে সঠিকভাবেই বলেছেন, বিচার বিভাগ ও সংসদ ভাইবোনের মতো। ‘প্রকৃত অর্থে কার্যকর বিচার প্রশাসন’ নিশ্চিত করতে তাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বিচার বিভাগ ও সংসদ উভয়েই গণতন্ত্রের সন্তান। ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে তাদের হাতে হাত রেখে কাজ করতে হবে। একজন ভুল করলে আরেকজনকে তা শুধরে দিতে হবে।
কিন্তু কর্মীদের চাপে আদালতের রায় প্রভাবিত হয়—এমন ধারণা দূর করা দরকার। ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিটি বিচারক নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থা দূর করবে, এমনটা আশা করা হচ্ছে, যাতে বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় নির্বাহী বিভাগ আরও অধিকহারে যুক্ত হয়। একসময় তা ছিলও বটে। কিন্তু দেখা গেল যে বিচারক নিয়োগ ও বদলির প্রক্রিয়ায় সরকারের হস্তক্ষেপ রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ফলে ব্যাপারটা পুরোপুরি বিচারকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ভারত হিন্দু রাষ্ট্র, হিন্দুত্বই পরিচয়, ফের ঝড় তুললেন ভাগবত
তার পরও কলেজিয়াম ও নির্বাহী বিভাগ উভয়েই বিচারক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে আইন কমিশনকে আরও ভাবতে হবে, কীভাবে বিচার বিভাগকে যেকোনো প্রভাবের বাইরে রাখা যায়। আর নির্বাহী বিভাগ কী বলে, তা-ও আমলে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবেই বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সংবেদনশীলতা আমলে নেওয়া হয়, কারণ তারা উভয়েই জনগণের প্রতিনিধি।
উদাহরণস্বরূপ, যেকোনো সিদ্ধান্তের কারণ জানার ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এটা দাপ্তরিক সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা এনেছে, গণতন্ত্রকে গভীরতর করেছে। সত্য প্রকাশিত হলে সরকার হয়তো বিব্রত হতে পারে। কিন্তু একটি উন্মুক্ত সমাজের দাবির প্রসঙ্গে আপস হতে পারে না।
এ পর্যন্ত বিবেচনা করলে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিরীক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে বুঝতে হবে, সরকারি কর্মচারীরা তাদের কাজ করে। অনেক দুর্নীতির তদন্তের প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখত, যদি সেগুলোয় দাপ্তরিক সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করা না হতো।
মোদি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগকেও নির্বাহী বিভাগের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। সময়-সময় নানা নীতি প্রণয়ন করা তাদের অধিকার। শেষ বিচারে উভয়কেই সংবিধানের সীমা অনুসারে কাজ করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.