বিচারহীনতা ও নৈতিকতার অভাবে নারী লাঞ্ছনা ঘটছে -বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে অভিমত

অতীতের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং নৈতিকতার অভাবে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটছে। এ ঘটনার জন্য শুধু নারীর পোশাককে দায়ী করলে হবে না। বরং পুরুষের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। তবে পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য সংবেদনশীল। এতে করে নাগরিকের মনে সংশয় তৈরি হবে। অপরাধী যেই হোক তাকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আজ রোববার দুপুরে রাজধানীতে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নেয়া প্যানেল আলোচক ও দর্শকেরা এ কথাগুলো বলেন।
আগের ঘটনার বিচার কি হয়েছিল? এবারের ঘটনার বিচার ও কি হবে?
বস্ত্রহরণরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগ নেতা রাসেল ও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা আলম
রাজধানীতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) মিলনায়তনে বিবিসি বাংলাদেশ সংলাপের ১১৩তম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্যানেল আলোচক ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশ অ্যালায়েন্স ফর উইমেন লিডারশিপ’র নির্বাহী পরিচালক নাসিম ফিরদৌস ও বাংলাদেশ পরিবেশবাদী আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন বিবিসির সংবাদদাতা আকবর হোসেন।
অনুষ্ঠানে এক দর্শক প্রশ্ন তোলেন- পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের দিনে প্রকাশ্যে নারীদের লাঞ্ছনার সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার কি হবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে গওহর রিজভী বলেন, এখানে সরকার কোনো ছাড় দেবে না। এ ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য নয়। এদের আইনের সামনে আনতে তথ্য প্রমাণ করতে হয়। এ জন্য কিছু সময় লাগবে। এর পাশাপাশি আমাদের নাগরিকদেরও কিছু করার আছে। আমরা যদি এর প্রতিবাদে সক্রিয় অংশ না নেই, তবে এ ধরনের ঘটনা সব সময়ই ঘটতে থাকবে। এ ঘটনায় পুলিশ যদি সত্যিই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নেয় তবে সে বিচারও করতে হবে বলেন তিনি। এ নিয়ে ধৈর্য্য ধরতে বলেন তিনি।
এ সময় এক দর্শক মন্তব্য করেন- অতীতে থার্টি ফার্স্ট নাইটে বাঁধন নামে এক নারীর বস্ত্রহরণ হয়েছিল। ওই ঘটনার বিচার হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা ধর্ষণের সেঞ্চুরি করেছিলেন। তারও বিচার হয়নি। এসব ঘটনার জন্য প্রশাসনই দায়ী।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, নারী লাঞ্ছনার বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং জঘন্য অপরাধ। এ নিয়ে পুলিশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য দু:খজনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িতরা কোমরের জোরে দোষ করে পার পেয়ে যায়।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বিচারের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য সংবেদনশীল। বিচার না হতে পারে, তবে বিচারের দাবি থেকে সরে আসা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি সহ আরো অনেক স্থানে নারীকে
বিবস্ত্র করে যৌন নির্যাতন করা হয়। হরণ করা হয় নারীর সতীত্বকে।
বর্ষবরণের নামে যা করা হয়েছে তার দায়ভার কে নেবে? এভাবে
বাংলা উৎসব গুলি বা নববর্ষতে যদি নারীর শ্লীনতাহানি,
নারীর প্রতি পাশবিক অত্যাচার,নববর্ষ মানে যদি হয়
আমার দেশের ধর্ষিতা মা-বোনদের করুন আর্তনাদ!
নাসিম ফিরদৌস বলেন, আমাদের সচেতনতার অভাব কেনো? নারীকে তার স্বাধীনতা দিতেই হবে। তবে, এখানে প্রশাসনের যে দায়িত্ব এড়ানোর প্রবণতা আমরা কখনোই আশা করি না। অতীতের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আরেক দর্শক প্রশ্ন করেন- যৌন হয়রানীর জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করার সংস্কৃতির শেষ কোথায়? জবাবে নাসিম ফিরদৌস বলেন, নারী কিন্তু নিজেই শালীনতা বজায় রাখতে চায়। তবে নারীদের পোশাককে দায়ী করা বন্ধ করার জন্য ঘরে থেকে পুরুষদের বুঝাতে হবে। নারীর পোশাক নিয়ে কথা বলা হচ্ছে নারীর ওপর আঘাত।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, নারীর পোষাককে দায়ী করা মানে ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা। অস্থির রাজনীতি ও নৈতিকতার অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে নারীর পোষাককে দায়ী করা হচ্ছে। কে কী পোশাক পড়বে তা না শিখে, পুরুষ কিভাবে দৃষ্টি দিবে তা শিক্ষার দরকার। মূলত বিচারহীনতা এবং নৈতিকতার অভাবে নারী লাঞ্ছনা ঘটছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তৃতীয় প্রশ্ন ছিলো- মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের ফাঁসির রায় কার্যকর না করতে জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশ আহবান জানিয়েছে। বাংলাদেশের কি উচিত এসব পরামর্শ বিবেচনা করা?
জবাবে নাসিম ফিরদৌস বলে, সবচেয়ে উচ্চ আদালত ফাঁসির রায় দিয়েছে। বাইরে থেকে যেসব প্রতিক্রিয়া আসে সেটা শোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই। দেশের নাগরিক কি চায় তা বুঝতে হবে।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, তারা তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। আমাদের দেশের আইন আমরা পালন করবে। আইন যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে কি না তা ভাবতে হবে। তবে বহির্বিশ্বের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এলে, আইন আমরা রাখবো কিনা সেটা দেখতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, কোনো সংগঠন বলতেই পারে, বিবেচনায়ও নেয়া যেতে পারে, তবে আমাদের দেশের আইন আমরা পালন করবো।
গওহর রিজভী বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, আমাদের আইন আমরা পালন করবো। এখানে কিছুটা হিপোক্রেসি আছে। যারা নিজেরা ফাঁসি দেয় আর অন্যদেরকে বলে ফাঁসি না দিতে তাদের কথা গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই।
অনুষ্ঠানে চতুর্থ প্রশ্ন ছিলো- ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কি সবার জন্য সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছে?
ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, কিছু প্রার্থী অভিযোগ করছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকছে না। ভয়-ভীতি শঙ্কার উর্দ্ধে উঠে, নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে হবে যে, সবাই যেন নির্বিঘ্নে অংশ নিতে পারে।
নাসিম ফিরদৌস বলেন, সমান সুবিধা নেই এমন কথা গণমাধ্যমের মাধ্যমে বলে লাভ নেই। অভিযোগ করার একটি পদ্ধতি আছে। সেভাবে করতে হবে। তবে এবারে সত্যিকারের নির্বাচন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগের স্তূপের কথা শোনা যাচ্ছে। আইন আচমকা জোরে চলা শুরু করলে একটু সমস্যা হয়। কিছু বিষয় যেগুলো নির্বাচন কমিশন বলবে, সেগুলো মন্ত্রীদের কাছ থেকে শুনতে পাই। যেমন নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকবে কি না?
গওহর রিজভী বলেন, নির্বাচন কমিশনকে সরকার থেকে পৃথক করতে হবে। নির্বাচন কমিশন নিজে তার ক্ষমতা ব্যবহার না করলে সেটা দেখার দায়িত্ব সরকারের না।

No comments

Powered by Blogger.