সীমান্তের ওপারে ৬২ ফেনসিডিল কারখানা by তোহুর আহমদ

বাংলাদেশের সীমানা সংলগ্ন ভারতীয় অংশে শনাক্ত করা হয়েছে ৬২টি বড় ধরনের ফেনসিডিলের কারখানা। এসব কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল নেশার উপযোগী করে তুলতে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক (কোডিন ফসফেট) মেশানো হচ্ছে। বছরে কমপক্ষে এক কোটি বোতল বিশেষ ধরনের এই ফেনসিডিল বাংলাদেশে ঢুকছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জনায়। দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে মালিকের নাম-ঠিকানাসহ সীমান্তবর্তী ফেনসিডিল কারখানাগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করে একটি তালিকা তৈরি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরবর্তীকালে তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। পাশাপাশি এটি গত মাসে সফরকারী ভারতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোর (এনসিবি) মহাপরিচালকের হাতেও তুলে দেয়া হয়েছে।
ভারতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোর মহাপরিচালক বিবি মিশ্রর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ২২ ও ২৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেয়। ওই বৈঠকে কারখানাগুলোর তালিকা দিয়ে এগুলো বন্ধের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা। তালিকা পেয়ে আনুষ্ঠানিকভবে কারখানাগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও বাংলাদেশে ফেনসিডিল পাচার বন্ধে দিল্লির কঠোর অবস্থানের কথা জানায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।
৬২ কারখানা : সূত্র জানায়, বিজিবির তালিকায় মোট ৬২টি ফেনসিডিল কারখানার বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তেই ১০টি কারখানা রয়েছে। তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, ত্রিপুরার সোনামুরা বাজারের তিনটি ফেনসিডিল কারখানার মালিক হলেন- প্রবাল সাহা, মিহির আলী ও সেলিম মিয়া। সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে এই তিন কারখানার দূরত্ব মাত্র ৪শ মিটার। এ কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল গোলাবাড়ী ও বিরিবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। আগরতলার জাগোহরিমুড়ায় রয়েছে চারটি কারখানা। এগুলোর মালিক অসিত সাহা, মানিক সাহা, উত্তম পাল ও প্রদীপ দেবনাথ। কারখানাগুলোর অবস্থান সীমান্ত থেকে দেড় কিলোমিটার ভেতরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও কসবা সীমান্ত এলাকা দিয়ে এ কারখানাগুলোর ফেনসিডিল বাংলাদেশে ঢুকছে। এছাড়া আগরতলার শান্তিপাড়া (মসজিদ পট্টি পুকুরপাড়) এলাকার কারখানাটির মালিক অমর সাহা। সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব দুই কিলোমিটার। তালিকায় বলা হয়েছে, দক্ষিণ ত্রিপুরার শ্রীরামপুরে একটি কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল ফেনী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। দুলাল মিয়া নামের এক ব্যক্তি এই কারখানার মালিক। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ৬ মিটার দূরত্বে শ্রীরামপুরের সিদ্ধিনগর এলাকায় একটি কারখানার অবস্থান। জনৈক অরজুন এটির মালিক। ত্রিপুরার বিকাশনগর (আজিমপুর) ও মধুপুর পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে দুটি কারখানা। এছাড়া পশ্চিম ত্রিপুরার গান্ধিগ্রামে একটি কারখানার অবস্থান। এর মালিকের নাম নির্মল শীল।
এছাড়া তালিকা অনুযায়ী, ত্রিপুরার নারায়ণপুর গ্রামে একটি কারখানা চালাচ্ছেন তপন দাস। পশ্চিম ত্রিপুরার নরসিং এলাকায় জনৈক কৃষ্ণর মালিকানাধীন একটি কারখানা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এ এলাকায় জাভেদ দাস নামের আরেক ব্যক্তির একটি কারখানাও চালু আছে। আর পশ্চিম ত্রিপুরার সিপাইজোলার বিশ্রামগঞ্জে একটি কারখানা রয়েছে। এর মালিক বিজয় ঘোষ নামের এক ব্যক্তি। মুরশিদাবাদের জঙ্গিপুর, ডাকবাংলা বাজার ও দুলিয়ান বাজারের তিনটি কারখানার মালিক যথাক্রমে সুখচাঁদ চন্দ্র, অনু মোদি ও বাদল। এ এলাকার নাসিরাপাড়ায় আরেকটি কারখানা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। মালদহ জেলার শোভাপুর, রথবাড়ী, রাজ হোটেল, গোপালগঞ্জ বাজার, সাহাসনি বাজার, ঘোষঘাট বাজার, মোহদিপুর বাজার, কমলাবাড়ী বাজারের কারখানাগুলোর মালিক যথাক্রমে কৃষ্ণা সামন্ত, আরশেলী, আসু সাহা, চেটু, শ্যামল ঘোষ, ভবেশ মণ্ডল, অশোক রায়, রাম ঘোষ ও প্রবীণ কুমার। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুর ঘাট ও হিলি এলাকায় তিনটি কারখানা আছে। এগুলোর মালিক যথাক্রমে সতীষ কুমার, মহেন্দ ও গাওন বর্মণ। কুচবিহার জেলার শীতলকুচি ও বাংলাবাজার এলাকায় দুটি কারখানা শনাক্ত করা গেলেও মালিকদের শনাক্ত করা যায়নি। তালিকায় বলা হয়েছে, নদীয়া জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় ৮টি কারখানা ও মালিকদের শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ ও উত্তর চব্বিশ পরগোনা, মুর্শিদাবাদ ও দমদমের সীবান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত ১৬টি কারখানার অবস্থানসহ বিস্তারিত তথ্য তালিকায় তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশে মাদক চোরাচালান নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বলছে, ভারতীয় সীমান্তবর্তী কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ফেনসিডিল ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে ওষুধ হিসেবে বিক্রি হয় না। কারণ এসব ফেনসিডিল বিশেষ ব্যবস্থায় উৎপাদিত হয়। এতে মাত্রাতিরিক্ত কোডিন ফসফেট মেশানো থাকে যাতে করে নেশা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরীক্ষাগারে একাধিক রাসায়নিক পরীক্ষায়ও এ বিষয়টি ধরা পড়ে। অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা যুগান্তরকে বলেন, ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা ফেনসিডিলে কোডিনের সমতা পাওয়া যায়নি। কোনো বোতলে আড়াইশ মিলি আবার কোনো বোতলে তিনশ মিলি থাকে। অর্থাৎ প্রতি ৫ মিলিলিটারে ১০ মিলিগ্রামের জায়গায় ১৫ মিলিগ্রাম বা তারও বেশি থাকে। এটি একেবারেই অস্বাভাবিক মাত্রা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক পরিচালক আবু তালেব যুগান্তরকে বলেন, কফ সিরাপ হিসেবে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রে ফেনসিডিল দেয়া হয়। ভারতীয় ওষুধ প্রশাসনের নির্ধারিত মান অনুযায়ী ফেনসিডিলের প্রতি ৫ মিলিলিটারে ১০ মিলিগ্রাম কোডিন থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে পাচারকৃত ফেনসিডিলে উচ্চমাত্রার কোডিন মেশানোর কারণেই এটি নেশার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সীমান্ত সংলগ্ন ফেনসিডিল কারখানাগুলো মূলত একেকটা কিচেন ল্যাব। সেখানে রাসায়নিক মাপজোকের কোনো ব্যবস্থা নেই। চোখের আন্দাজে কোডিন ফসফেট হাত দিয়ে ঢেলে তারা ফেনসিডিল উৎপাদন করে। এ কারণে কোডিন ফসফেটের পরিমাণের সমতা থাকে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ফেনসিডিল ব্র্যান্ডের এই ভারতীয় কফ সিরাপ এখন ভিন্ন নামেও বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ফেনসিডিল পাচার কিছুটা কমে যাওয়ার কারণ ক্ষতিয়ে দেখতে গিয়ে এ তথ্য বেরিয়ে আসে। জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) প্রণব কুমার নিয়োগী যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে ফেনসিডিল চোরাচালান কিছুটা কমেছে। কিন্তু নেশা হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নতুন ব্র্যান্ডের কিছু কফ সিরাপ সম্প্রতি ধরা পড়ছে। এসব সিরাপের বোতল, লেবেল ও বোতলের ছবি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী ভারতীয় ফেনসিডিল কারখানাগুলোর তালিকার বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বজলুর রহমান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তালিকা পেয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছে, এগুলোর বিরুদ্ধে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবে। আমার মনে হচ্ছে ভারত এ বিষয়ে সত্যি আন্তরিক। তারা বাংলাদেশে সব ধরনের মাদক পাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.