অপেক্ষায় সালাহউদ্দিন আহমেদের পরিবার by কাজী সুমন

বাবাকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় সালাহউদ্দিন আহমেদের সন্তানেরা। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে তাদের। অজানা আতঙ্কে বন্ধ রয়েছে ছোট দুই সন্তানের স্কুলে যাওয়া। বাবাকে ফিরে পেতে নফল রোজা রাখছেন পরিবারের সদস্যরা। সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী সাবেক এমপি হাসিনা আহমেদ স্বামীর খোঁজে দিনভর ছোটাছুটি করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তর ও আদালতের বারান্দায়। ধরনা দিচ্ছেন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের কাছেও। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকেই আশার কোন বাণী পাননি তিনি। সালাহউদ্দিন নিখোঁজ হওয়ার পর গত ৬ দিন ধরে চুলায় আগুন জ্বলেনি তার বাসায়। নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাসিনা আহমেদ বলেন, ১০ই মার্চ রাত ১০টার দিকে সালাহউদ্দিন আমাকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু কথা বলতে পারেননি। আমার ধারণা ওই সময়ে তাকে আটক করা হয়। তিনি হয়তো এ সংবাদটাই আমাকে জানাতে চেয়েছিলেন। এর আগে আমাদের বাসায় কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসেছিল। কিন্তু তাকে না পেয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদের পিএ এবং দুই গাড়িচালককে আটক করে নিয়ে যায়। তারা রিমান্ড শেষে বর্তমানে কারাগারে আছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ গুম হওয়ার আশঙ্কা কখনও করেননি মন্তব্য করে হাসিনা আহমেদ বলেন, আগে থেকেই তিনি গ্রেপ্তারের আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু নিখোঁজ বা গুম হতে পারেন- এমন আশঙ্কার কথা আমাকে কখনও বলেননি। হাসিনা আহমেদ বলেন, ওইদিন ঘটনার সময় তিনি যে বাসায় ছিলেন, তার মালিক এ ঘটনায় প্রচ  রকমের ভয় পেয়ে পরদিন সকালেই দেশ ছেড়ে দুবাই চলে যান। তিনি আমাকে ফোনে ঘটনার বিবরণ জানান। একইসঙ্গে ওই বাসার দারোয়ানও আমাকে জানান, ঘটনার রাতে ডিবি পরিচয়ে ১৫-২০ জনের একটি টিম সালাহউদ্দিন আহমেদকে বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায়। এসময়ে তার চোখ ও হাত বাঁধা ছিল বলেও তারা আমাকে জানিয়েছে। তিনি বলেন, আসলে আমি রাজনীতি নিয়ে কখনও মাথা ঘামাইনি। আমার স্বামীই রাজনীতি নিয়ে থাকতো। এখন তার নিখোঁজের পর আমরা তো আর বসে থাকতে পারি না। চেষ্টা করছি। দলের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আমাকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। এছাড়া দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও যোগাযোগ রাখছেন। সাহস যোগাচ্ছেন। পিতার নিখোঁজের হওয়ার সন্তানরা ভেঙে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বড় ছেলে ইব্রাহিম (২৩) কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করছেন। দ্বিতীয় সন্তান ইকরা (১৯) মালয়েশিয়ায় একটি মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন। বড় দুই সন্তান ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে বাবার খোঁজ জানতে চাইছেন। মার কাছে ফোন করে তারা কান্নাকাটি করেন। বাবাকে ফিরে পেতে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। ইন্টারনেটে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে খোঁজ রাখছেন- কোথাও বাবার সন্ধানের কোন সংবাদ আছে কিনা। এদিকে তৃতীয় সন্তান রাইদা (১৭) রাজধানীর একটি স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। সবচেয়ে ছোট সন্তান ইউসুফ (১৪) নবম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। পিতা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। বাবাকে ফিরে পাওয়ার আশায় নফল রোজা রাখছে তারা। সালাহউদ্দিনের এক নিকটাত্মীয় জানান, ১১ই মার্চ নিখোঁজের ঘটনা জানার পর থেকে তাদের বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ রয়েছে। বাইরে থেকে আত্মীয়-স্বজনরা শুকনো খাবার যা নিয়ে আসছেন সেটাই তারা খাচ্ছেন। তবে ছোট দুই সন্তান রাইদা ও ইউসুফ বাবার জন্য প্রতিমুহূর্তেই কান্নাকাটি করছেন। ছেলে-মেয়ে দুটির চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তাদের জোর করেও কোচিংয়ে পাঠানো যাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজন যারাই বাসায় আসেন তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। বাসার পরিবেশ দেখে মনে হয়, এটা কোন মৃত বাড়ি। এদিকে স্বামীর সন্ধানের জন্য গত কয়েকদিন ধরে আদালত প্রাঙ্গণ ও আইনজীবীদের দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করছেন হাসিনা আহমেদ। সালাহউদ্দিনকে আদালতে হাজির করতে হাইকোর্টে দায়ের করা শুনানি দুদফা রোববার ও সোমবার অনুষ্ঠিত হয়। আগামী ৮ই এপ্রিল পর্যন্ত শুনানি মুলতিব ঘোষণা করেছে আদালত। সোমবার রাত পর্যন্ত সালাহউদ্দিনের কোন সন্ধান জানতে পারেননি তারা। উল্লেখ্য, গত ৩০শে জানুয়ারি রাতে বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে গ্রেপ্তারের পর থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদ দলের দপ্তরের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ৩৯ দিন দায়িত্ব পালন করার পর রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে তাকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায় ১৫-২০ জন লোক। ২০১৩ সালের শেষদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন একইভাবে রিজভী আহমেদ গ্রেপ্তারের পর দপ্তরের দায়িত্ব পালন করছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। সেবারও তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করেছিল পুলিশ। কিন্তু এবার নিখোঁজের ৬ দিন পরও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তাকেও  বিএনপির নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীর ভাগ্য বরণ করতে হয় কিনা- এই প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছে।
সালাহউদ্দিনকে খোঁজা নিয়ে রুলের শুনানি ৮ই এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করা নিয়ে জারি করা রুলের শুনানি আগামী ৮ই এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ আদেশ দেন। আজ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট বন্ধ থাকবে। গতকাল ছুটির আগে শেষ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আবেদনের পক্ষে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শুনানি করেন। পরে সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আদালতে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে তা মিথ্যা।
এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মঙ্গলবার রাতে সালাহউদ্দিন আহমেদকে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীও একই তথ্য জানান। সালাহউদ্দিন আহমেদকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে গত বৃহস্পতিবার হাসিনা আহমেদ হাইকোর্টে একটি আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সালাহউদ্দিন আহমেদকে কেন খুঁজে বের করা হবে না এবং কেন হাজির করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রোববার হাইকোর্টে এ ব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পুলিশ, র?্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বিশেষ শাখা (এসবি)। পাঁচটি প্রতিবেদনেই বলা হয়, সালাহউদ্দিন আহমেদের খোঁজ জানে না পুলিশ। তারা তাকে গ্রেপ্তার বা আটক করেনি।
সালাহউদ্দিনকে খুঁজে না পাওয়া রাজনীতির অশুভ লক্ষণ: সুরঞ্জিত
এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে না পাওয়া রাজনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেছেন, সবমহলের প্রচেষ্টায় সালাহউদ্দিনকে খুঁজতে হবে। আশা করি সালাহউদ্দিন সম্পর্কে ভাল খবর পাব। গতকাল দুপুরে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘চলমান রাজনীতি’ বিষয়ক এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। ‘নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী’ নামের একটি সংগঠন এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে সহিংসতাকে উসকে দিয়েছেন অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা বলেন, এতদিন পর খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে আসলেন। মানুষ ভেবেছিল সংবাদ সম্মেলনে চলমান সংঘর্ষ-সংঘাতের রাজনীতি পরিহারের কথা বলবেন তিনি। কিন্তু উনি যেন এই সংঘাতের রাজনীতিকে আরও উসকে দিলেন। সুরঞ্জিত বলেন, খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র নেতারা ছিলেন না। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এত বড় নেতা। উনার পরিচয় লিখতে গেলে এক পাতা শেষ হয়ে যায়। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, যিনি নেত্রী ডাকলেও আছেন, না ডাকলেও আছেন। তিনিও উপস্থিত ছিলেন না। অন্তরালের রাজনীতি অন্তর্ধানে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, রাজনীতি হবে প্রকাশ্যে। জনগণের জন্য জনগণকে নিয়েই হবে রাজনীতি। অন্তরালের রাজনীতি না হওয়াই ভাল।
তিনি বলেন, বেগম জিয়ার অফিস আছে, লোকজন আছে। সেখান থেকে খবর পাঠালে কী হতো? রাজনীতি কোন অজানা পথে যাচ্ছি আমরা জানি না। সুরঞ্জিত বলেন, বাংলাদেশ বাংলাদেশেই থাকবে। বাঙালি বাঙালিই থাকবে। এ দেশকে মধ্যপ্রাচ্য বানানো যাবে না। এ দেশের শ্যামল মানুষকে উগ্র জঙ্গিবাদী বানানো যাবে না। গণতন্ত্রই আমাদের ঐতিহ্য। গণতন্ত্রই আমাদের রাজনীতি। আলোচনা সভায় আয়োজক সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
৬ দিনেও সালাহউদ্দিনকে খুঁজে না পাওয়ায় ড্যাবের উদ্বেগ
দীর্ঘ ৬ দিনেও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে না পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক যুক্ত বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন ড্যাব-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে এম আজিজুল হক ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, সালাহউদ্দিনের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় স্পষ্ট যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, থানায় তাদের জিডি পর্যন্ত নেয়া হয়নি। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে শরণাপন্ন হন তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য হাসিনা বেগম। কিন্তু সেখানেও আজ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫টি সংস্থা আদালতকে জানান- তারা কোন সন্ধান পাননি। এতে পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনরা আতঙ্কিত। তারা আরও বলেন, ছেলে-মেয়েদের কান্নার রোলে ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। দেশের সাধারণ জনগণের মতো ড্যাবও এই নিখোঁজের ঘটনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তারা বলেন, সালাউদ্দিন আহমেদের মতো সজ্জন, দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক আমলা, আজ ৬ দিন ধরে নিখোঁজের পরও তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনভিতপ্রিয় বক্তব্য দেশের সাধারণ মানুষকে ব্যথিত করেছে। আমরা এরূপ বক্তব্যের নিন্দা জানাই। সরকার যেখানে আজ পর্যন্ত বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী, ঢাকার জনপ্রিয় ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমসহ হাজার হাজার  নেতাকর্মীর সন্ধান দিতে পারেনি। সেই ব্যর্থ সরকারই আজ সালাউদ্দিনকে নিয়ে নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। আমরা চিকিৎসক সমাজ সাধারণ জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি এবং সকল নোংরামি বন্ধ করে অনতিবিলম্বে সালাউদ্দিন আহমেদকে অক্ষত অবস্থায় তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। বিবৃতিতে তারা বলেন, সরকার যদি সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে কোনরূপ অপকৌশলের আশ্রয় নেয় তাহলে দেশের জনগণ তাদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। বাংলার মাটিতে এসকল দুষ্কৃতকারীদের এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে যাবে ভবিষ্যতে এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তির সাহস কেউ দেখাতে না পারে।

No comments

Powered by Blogger.