আরেক আগুনবোমার কথা by মনজুরুল হক

বাংলাদেশের মানুষ আগুনবোমায় দগ্ধ হচ্ছে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে। আগুনবোমার এই খেলাটা চলছে রাজনীতির দোহাই দিয়ে। রাজনীতির নামে এ রকম বেলেল্লাপনা বাংলাদেশে কেন, বিশ্বের অন্য কোনো দেশেই এর আগে দেখা যায়নি। আর আগুনে রোমের দগ্ধ হওয়ার সেই গল্পের মতোই আমাদের রাজনীতির সূত্রধরেরাও বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন। তবে সুর কিছুটা ভিন্ন। ইতিহাসের ভিন্ন ব্যাখ্যা অবশ্য এ রকম আভাস দেয় যে সম্রাট নিরো বাঁশিতে করুণ সুর তুলছিলেন আগুন নেভাতে নিজের অক্ষমতার বেদনা থেকে। অন্যদিকে, একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের মানুষকে পেট্রলবোমার আগুনে পুড়িয়ে মারার পর বাঁশির যে সুর আমরা শুনছি, তা অনেকটা এ রকম—আমাকে ক্ষমতা দাও, আমি তোমার আগুনে ঝলসে যাওয়া ক্ষতের শুশ্রূষা করব; আমাকে নিয়ে যাও কাঙ্ক্ষিত সেই সিংহের আসনে, তোমার অগ্নিদগ্ধ ঘর আমি আবার গড়ে দেব। তবে তার আগে অল্প একটু যন্ত্রণা যে তোমাকে সইতেই হয়। সেই যে কথায় আছে না—ভোগে নয়, বরং ত্যাগেই মেলে প্রাপ্তি। আগামীর প্রাপ্তির প্রত্যাশায় একটু ত্যাগ না–হয় আজ তুমি স্বীকারই করে নিলে!
আগুনের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক মনে হয় আগুনকে মানুষ বশে আনতে পারার পর থেকেই। আগুন যে জীবনের উৎস, সেই বাস্তবতা থেকে একসময় সূচনা হয়েছিল অগ্নি উপাসনার। পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলের মানুষ এখনো জীবনের উৎস আগুনকে দেবতা হিসেবে গণ্য করে থাকে। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় আগুন একদিকে যেমন মানুষের জন্য খুলে দিয়েছে প্রগতির পথ ধরে যাত্রা শুরু করার দুয়ার, অন্যদিকে সেই একই আগুন মানুষকে দীক্ষা দিয়েছে বর্বরতার। আগুনের শক্তি উপলব্ধি করে অন্যকে কাবু করতে পারার হাতিয়ার হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষ আগুনকে ব্যবহার করেছে যুদ্ধের জুতসই অস্ত্র হিসেবে। চেঙ্গিস খান আর হালাকু খানেরা যুদ্ধজয়ের পর যে উন্মাদনায় মত্ত হতেন, তা হলো দাউ দাউ অগ্নিশিখায় জ্বালিয়ে দেওয়া বর্ধিষ্ণু সব জনপদ। সেই উন্মাদনার হাত থেকে রক্ষা পেত না কোনো কিছুই।
ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে আগুনের সে রকম বর্বর ব্যবহারে সব সময় সবচেয়ে বেশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা হলো সাধারণ মানুষ, আগুনের ব্যবহারের মতোই শাসক আর শোষকের ব্যবহারের বস্তুতে বরাবর যারা পরিণত হয়ে থাকে। প্রগতির চাকা এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখলেও আজও থেমে নেই আগুন নিয়ে মানুষের তাণ্ডবে মত্ত হওয়ার খেলা। সে রকমই এক ভয়াবহ খেলায় আজ থেকে ৭০ বছর আগে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছিল এক লাখের বেশি সাধারণ মানুষ। সংখ্যাগত হিসাবের দিক থেকে বর্বরতার মাত্রা চেঙ্গিস-হালাকুকে ছাড়িয়ে গেলেও রাজনীতির হিসাব-নিকাশের মস্ত এক প্যাঁচে সেই নিহত ব্যক্তিদের কথা এখন আর সেভাবে কেউ স্মরণ করেন না।
১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ মধ্যরাতের ঠিক অল্প পরে এগিয়ে আসা বিমানবহরের শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জাপানের রাজধানী টোকিওর শিতামাচি বা কেন্দ্রস্থলের সুমিদা ওয়ার্ডের অধিবাসীদের। গর্জন তুলে এগিয়ে আসা বি-২৯ বোমারু বিমানের বহর শিতামাচির ঠিক ওপরে এসে পৌঁছে যাওয়ার পর সেসব বিমানের পেটের আচ্ছাদন খুলে গিয়ে সেখান থেকে সমানে বের হয়ে আসে পেট্রোলিয়াম জেলিতে পরিপূর্ণ বোমা আকারের আধার। সেসব আধার নদী আর খালগুলোকে পরিণত করে দেয় জ্বলন্ত অগ্নিগোলকে। আর মানবদেহের স্পর্শে আধারে সংরক্ষিত পেট্রোলিয়াম জেলি এলে দেহের ত্বক আর মাংস ভস্মে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত জ্বলতে থাকে আগুন। ফলে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা মানুষ প্রাণভয়ে দৌড়ে ছুটে চলছিল এমন এক নিরাপদ আশ্রয়ে, যেখানে লুকিয়ে থেকে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে। তবে এদের অনেকেই সে রকম সৌভাগ্যের আশ্রয়ের দেখা পায়নি। কেননা, মাথার ওপর তাদের সমানে গুঞ্জন করে উড়ছিল অগুনতি সব আগুনবোমা ফেলতে থাকা বিমান।
সেদিন যারা রাতের আঁধারে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দিশেহারার মতো পথজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল, তাদের একজন হলেন ৯১ বছর বয়সী মিচিকো কিওকা। ১০ মার্চ টোকিওর সুমিদা ওয়ার্ডে বোমা হামলার ৭০তম বার্ষিকীতে আয়োজিত স্মারক অনুষ্ঠানে মর্মান্তিক সেই অভিজ্ঞতার সাক্ষী অল্প কয়েকজন প্রাণে বেঁচে যাওয়া টোকিওবাসীর মধ্যে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। স্মারক অনুষ্ঠানের শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘ওপরে তাকালে চোখে পড়ছিল আকাশজুড়ে ফড়িংয়ের মতো দলবদ্ধ হয়ে উড়ে চলা অসংখ্য বিমান, আর চোখ নিচে নামালেই দেখা যাচ্ছিল পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া সব মানবদেহ।’ বোমা হামলায় অনেকটা দৈবক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর বাবা আর বোন।
১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় প্রশান্ত মহাসাগরের সাইপান দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল ৩৩৪টি বি-২৯ সুপারফোর্ট্রেস বোমারু বিমান। যাত্রা শুরুর আগে সব কটি বিমানের কাঠামোগত রদবদল করে নিয়ে সেগুলোকে আরও বেশি বোমা বহনের উপযোগী করে নেওয়া হয়। জাপানের বিমানবাহিনী যুদ্ধের সেই শেষ বছরে এসে একেবারে কুপোকাত হয়ে পড়ায় খুব বেশি প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি যে হামলাকারী বিমানবহরকে পড়তে হবে না, মার্কিন সমরনায়কেরা তা অনুধাবন করতে পারায় খুব নিচু দিয়ে উড়ে গিয়ে বোমা ফেলার নির্দেশ বিমানের ক্রুদের দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি বিমানে বাড়তি জায়গা করে নিয়ে বোমার মজুত রাখা হয়েছিল সাত টনের মতো। ১০ মার্চ রাত ১২টা বেজে ১৫ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছে মাত্র ৫০০ মিটার উচ্চতায় নেমে আসে বিমানবহর এবং এর ঠিক পর পর শুরু হয় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ। তিন ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে চলা সেই বিমান হামলায় টোকিওর সুমিদা ওয়ার্ড ও আশপাশের এলাকাজুড়ে ফেলা হয় দুই হাজার টনেরও বেশি পেট্রলবোমা। দাউ দাউ আগুনে পুড়তে থাকে মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস ভবন আর কলকারখানা।
কেমন ছিল সেই ভয়াবহ বিমান হামলা? কাছে থেকে হামলা প্রত্যক্ষ করে মানুষের সেই দুর্দশা নিজের চোখে দেখার বিরল সুযোগ যাঁদের হয়েছিল, তাঁদের একজন হলেন ফরাসি সাংবাদিক রবার্ট জুলিয়ান। যুদ্ধের প্রায় পুরো সময় ধরে জাপানে তিনি সংবাদ সংগ্রহে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার পর আই স টোকিও বার্নিং নামে একটি বই তিনি লিখেছেন, যেখানে আমরা টোকিওর সেই ভয়াবহ বিমান হামলার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা খুঁজে পাই। সেই বর্ণনার অংশবিশেষ তাঁর বয়ানেই শুনে নেওয়া যাক:
‘আগুনে সেলাই করা মালায় আকাশ ছেয়ে দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তারা কাজে নেমে পড়ে। অন্ধকারে চারদিক থেকে আকাশ বরাবর উঠছিল আগুনের ফুলকি, যেন ক্রিসমাস ট্রির আগুনের সাজসজ্জাকে কেউ আকাশের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে এবং পরমুহূর্তেই সেগুলো আবার মাটিতে নেমে এসে ছড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের হলকা। হামলা শুরু হওয়ার মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে বাতাসে উড়ে গিয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে কাঠের তৈরি বাড়িঘরের ঘনবসতিপূর্ণ শহর এলাকায়।
‘নদী আর জলাশয়গুলো সব আগুন-তাড়িত মানুষের ভিড়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল। শুধু মাথা পানির ওপর ভাসিয়ে রেখে নারকীয় সেই যজ্ঞ বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় তারা ছিল। পরে অবশ্য এদের মধ্যে হাজার হাজার জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পানিতে ডুবে নয়, বরং আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ বাতাস থেকে শ্বাসকষ্টে তারা মারা গিয়েছিল। অন্যান্য জায়গায় আবার খালের পানি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে ভাগ্যহত সেসব আশ্রয় গ্রহণকারী সেখানে জীবন্ত সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।’
টোকিওর সেই বোমা হামলার বর্ণনা হিরোশিমা-নাগাসাকির মতোই মর্মান্তিক শোনালেও যুদ্ধের পর সেই স্মৃতি যেন অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ১০ মার্চের টোকিও বিমান হামলার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য সরকারি অর্থে নির্মাণ করা হয়নি কোনো জাদুঘর। এমনকি নিহত ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুতির কাজেও গাফিলতি লক্ষ করা গেছে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে জাদুঘর তৈরির একটি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের দ্বন্দ্বে সেটা আটকা পড়ে যায়।
এ ছাড়া যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার ঠিক পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হওয়ায় সরকারও যেন সে রকম এক ‘পরীক্ষিত’ মিত্রের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৬৪ সালে জাপান সরকার টোকিও বিমান হামলা মিশনের নেতৃত্ব দেওয়া মার্কিন সামরিক বাহিনীর জেনারেল কার্টিস লেমেইকে যুদ্ধের পর জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননায় ভূষিত করেছিল।
ইতিহাস তাই বড়ই জটিল এমন একটি বিষয়, ক্ষেত্রবিশেষে খুবই করুণ পরিণতি যা কিনা নিয়ে আসে। ১৯৪৫ সালের ১০ মার্চ টোকিওর নির্বিচার বোমা হামলার শিকার হওয়ার বেদনাদায়ক ঘটনা সে রকম এক সত্যকেই আমাদের সামনে তুলে ধরছে নাকি?
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.