চলমান সঙ্কট রাজনৈতিক নয় আইনশৃঙ্খলাজনিত -নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে মাহবুব-উল আলম হানিফ by জাকির হোসেন লিটন

চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, চলমান সঙ্কট কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নয়, এটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলাজনিত সাময়িক সমস্যা। তাই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ করবে এবং প্রচলিত আইনেই তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ানবাজারে নিজ কার্যালয়ে নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সাংগঠনিক অবস্থা ও বিশ্বকাপ ক্রিকেটসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন কুষ্টিয়া জেলা থেকে নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর ৫৬তম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু-কিশোর দিবসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, কীর্তিমান এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এ বাঙালির জন্ম না হলে বাংলাদেশেরও জন্ম হতো না। আজ আমাদের কোনো আত্মপরিচয়ও থাকত না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং এ দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোই ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। যার জন্য জীবনে তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া কোনকিছুই পরোয়া করেননি। শত যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট-বেদনাকে তিনি সহ্য করেছেন। ফাঁসির মঞ্চও তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ। এক কথায় বলতে গেলে বাংলা, বাঙালি ও শেখ মুজিবুর রহমান যেন একই বৃন্তে তিনটি চেতনার ফুল। বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে যেমনি বঙ্গবন্ধু চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবেন তেমনি বাংলার শোষিত-বঞ্চিত-নির্যাতিত-মেহনতি জনতার হৃদয়ে থাকবেন চিরভাস্বর হয়ে। তিনি বেঁচে থাকলে এত দিনে এ দেশ সোনার বাংলা হয়ে সারা বিশ্বে নেতৃত্ব দিত। শত বাধা সত্ত্বেও তার অবর্তমানে আজ তারই যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তারই নেতৃত্বে আজ বাঙালি জাতি বিভিন্নভাবে সারা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, দু’টি মতাদর্শের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ-সহিংসতা হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ, নিরীহ নারী ও শিশুদের কী অপরাধ। তাদের পুড়িয়ে মেরে বিএনপি কী স্বার্থ হাসিল করতে চায়। আসলে আন্দোলনের নামে তারা যা করছে সেটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এটা খুনিদের কাজ।
সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বারবার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে বিএনপি ছোটখাটো কোনো সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠন নয়। তারা একাধিকবার দেশের ক্ষমতায় ছিল। এ সময় তাদের বিশাল একটি কর্মীবাহিনী তৈরি হয়। তাই এত বড় একটি দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে কিছুটা সময় লাগতে পারে। এ জন্য জনগণকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। তবে ইতোমধ্যেই সারা দেশে পরিস্থিতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বাকিটাও খুব শিগগিরই হয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
তবে গত ৭০ দিনে যারা শতাধিক মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে এসব খুনিকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা দরকার বলে মনে করেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী এ নেতা।
চলমান সঙ্কট নিরসনে বিএনপির সাথে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো খুনির সাথে আলোচনা হতে পারে না। তবে তারা মানুষ হত্যা ও সহিংসতার দায়ভার স্বীকার করে নাশকতা বন্ধ করলেই সরকার সংলাপের কথা চিন্তা করতে পারে।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও সন্তু লারমার সাথে সরকার সংলাপে বসেছিল এমন বিষয় উত্থাপিত হলে তিনি বলেন, সন্তু লারমা তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার স্বীকার করে অস্ত্র জমা দিয়েছিল। এখন বিএনপিও যদি সেভাবে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিয়ে সন্ত্রাস বন্ধ করে তাহলে সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বাধা দিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট আরেকটি নির্বাচনের সম্ভাবনা নষ্ট করে দিয়েছে মন্তব্য করে হানিফ বলেন, ওই নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন-নাশকতা বন্ধ করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর যদি সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা হয় তাহলে নতুন করে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের চেষ্টা করা হবে। কিন্তু বিএনপি জোট প্রধানমন্ত্রীর সেই আশ্বাস বা শর্ত মেনে নেয়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরও তারা সারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রাখে। নির্বাচন ঠেকানোর জন্য পাঁচ শতাধিক ভোটকেন্দ্রে আগুন দেয়। ভোটদানে জনগণকে শুধু বাধাই দেয়নি, ১৪২ জন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা হরে। তাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নির্বাচনী কর্মকর্তাও। তাই সমঝোতা যেখানে হয়নি সেখানে কার জন্য এবং কেন সংসদ ভেঙে আবার নতুন করে নির্বাচন দিতে হবে? তারা যদি সব ধরনের নাশকতা বন্ধ করে সরকারকে নির্বাচনে সহযোগিতা করত তাহলে আজ হয়তো আরেকটি নির্বাচনের সম্ভাবনা ছিল।
বিএনপিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হচ্ছে নাÑ এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা ঠিক নয়। তারা যেকোনো সময় তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করতে পারে। এর আগে সারা দেশে বেগম জিয়া একাধিক জনসভা করেছে। রাজধানীতেও একাধিক কর্মসূচি পালন করেছে তারা। কিন্তু সরকার তাতে কোনো ধরনের বাধা দেয়নি। এখনো তারা যদি সব ধরনের নাশকতা বন্ধ করে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করে তবে প্রশাসন তাতে বাধা দেবে না। কারণ, প্রশাসনের সব শর্ত মেনে আওয়ামী লীগও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাই বিএনপি যদি অহিংস কোনো কর্মসূচি পালন করতে চায় সরকার তাতে বাধা না দিয়ে আগের মতোই সহযোগিতা করবে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ রহস্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এ বিশেষ সহকারী বলেন, হারিছ চৌধুরীসহ বিএনপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতা দেশের বাইরে আত্মগোপনে রয়েছেন। আমরা শুনেছিলাম সালাহউদ্দিন আহমেদও দেশের বাইরে থেকে বিবৃতি দিয়ে হরতাল অবরোধ ডাকতেন। কিন্তু তাদের পরিবার এখন বলছে তাকে নাকি উত্তরা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু একাধিক মামলার আসামি হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো তাকে দীর্ঘ দিন ধরে খুঁজছে। তাকে পেলে তো গ্রেফতার করা হতো। এর রহস্য কী বিএনপিই ভালো বলতে পারবে। তারা হয়তো সালাহউদ্দিনকে লুকিয়ে রেখে সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল নিয়ে থাকতে পারে। তবুও তাকে খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সালাহউদ্দিন আহমেদ কোনো ধরনের গুম বা অপহরণের শিকার হয়ে থাকলে তা রাজনীতিকদের জন্য খুবই খারাপ বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার এত দিন পরও তাকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে নাÑ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হানিফ বলেন, যত কিছুই হোক তিনি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তার ব্যাপারে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে একটু ভেবে চিন্তেই নিতে হয়। তাই সরকার সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। তবে তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না দেখালে প্রশাসন যেকোনো সময় সর্বোচ্চ এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হানিফ জানান, ইতোমধ্যে প্রায় ৪০টিরও বেশি জেলার সম্মেলন শেষ হয়েছে। এসব সম্মেলনের প্রায় প্রত্যেকটিতে উপস্থিত থেকে সম্মেলন ও নতুন কমিটি গঠনপ্রক্রিয়ায় কাজ করেছি। বাকি জেলাগুলোর সম্মেলন আগামী এপ্রিলের মধ্যেই শেষ হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সম্মেলন হয়ে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরও ঢাকা মহানগর কমিটি দেয়া হচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নগরকে দু’টি ভাগে ভাগ করে কমিটি দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কাজও চলছে। তাই একটু সময় নেয়া হচ্ছে। আশা করি নির্বাচনের পরই এ কমিটি দেয়া যাবে।
চলমান বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে হানিফ জানান, সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি খেলাধুলার সাথে জড়িত। তাই খেলাধুলা সম্পর্কে একটু বেশি খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করেন তিনি। বিশেষ করে ফুটবল ও ভলিবলই বেশি খেলা হতো। আর ক্রিকেট তেমন একটা না খেললেও এখন পুরো নজর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সে দারুণ অভিভূত তিনি। দেশপ্রেম, দক্ষতা আর নিজেদের সর্বোচ্চ মনোবল নিয়ে খেললে বাংলাদেশ হয়তো স্বপ্নের এ ট্রফি নিয়ে দেশেও ফিরতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন এ রাজনীতিক।

No comments

Powered by Blogger.