অনিয়ম দুর্নীতিতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত by নাজমুল আকন্দ

উপজেলার আড়াই লাখ মানুষের একমাত্র চিকিৎসাকেন্দ্র ৫০ শয্যাবিশিষ্ট তাড়াইল হাসপাতালটি নানা সমস্যা আর অব্যস্থাপনায় জর্জরিত। শুধু এ উপজেলাই নয়, সহজে যাতায়াতের জন্য পার্শ্ববর্তী নান্দাইল, কেন্দুয়া, মদন, ইটনা ও করিমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অনেক রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। নার্স সংকট, দালালদের দৌরাত্ম্য, ডাক্তারদের অবহেলাসহ নানা কারণে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয়, উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের নামেও চলছে হরিলুট। এখানকার বর্তমান চিত্র দেখলে মনে হবে হাসপাতালটি নিজেই যেন বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত হয়ে লাইফ সাপোর্টে আছে। এছাড়া এ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ও তার মেডিকেল অফিসার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, অসদাচরণ, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। আর এসব কারণে হাসপাতালটি সম্পর্কে এলাকাবাসীর অভিযোগের অন্ত নেই। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুগান্তরের পক্ষ থেকে গত এক সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০০৭ সালে হাসপাতালটি ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। ২৮ জন ডাক্তারের স্থলে বর্তমানে আছেন ২০ জন। এর মধ্যে সার্জারি বিভাগের একজন জুনিয়র কনসালটেন্ট দেড় বছর ধরে অনুপস্থিত। দুজন মেডিকেল অফিসার প্রেষণে অন্যত্র কাজ করছেন। অ্যানেসথেসিয়া, কার্ডিওলজি কনসালটেন্টসহ ৮ জন ডাক্তারের পদ শূন্য। তিনজন মেডিকেল টেনোলজিস্টসহ (ল্যাব), একজন করে ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাফার ও রেডিও গ্রাফারের পদ থাকলেও সবকটি শূন্য। ১৭ জন নার্সের মধ্যে আছেন মাত্র ৪ জন। হাসপাতালটিতে বায়োকেমিস্ট এনালাইজার মেশিনসহ উন্নত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হলেও লোকবলের অভাবে তা বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, রোগীদের চিকিৎসাসেবায় অধিকাংশ ডাক্তার উদাসীন। তারা প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত থাকেন। দেরিতে আসা ও নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই চলে যাওয়া ডাক্তারদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালে রোগীদের ওষুধ ও চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করা হয় না। রোগীর স্বজনদের ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, সিরিঞ্জ কিনে আনতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি ওষুধ সরবরাহ কম। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি ওষুধ অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গোপনে বাইরের বিক্রি করে দেন।
গত ১৫ মার্চ সকাল ৯টায় হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে শত শত রোগী ভিড় করলেও তাদের টিকিট দেয়া শুরু হয় ১০টায়। এ সময় ডিউটি ডাক্তারের রোস্টারে জরুরি বিভাগের ডাক্তার হিসেবে মেহেদি হাসানের নাম থাকলেও তিনি সেখানে নেই। তার পরিবর্তে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিচ্ছেন, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট জেসমিন আক্তার ও একজন ওয়ার্ডবয়। শুধু জরুরি বিভাগেই নয় পুরো হাসপাতালেই কোনো ডাক্তারের দেখা মেলেনি।
এছাড়া টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী, ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে ভর্তিকৃত রোগী ও চিকিৎসা নিতে আসা লোকজন অসুস্থ হওয়ার উপক্রম হয়। হাসপাতালে আসা রোগীদের নিয়ে দালাদের টানাটানি নিত্যদিনের ঘটনা। সরেজমিনে দেখা গেছে, জরুরি বিভাগের সামনে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে ৫০-৬০ জন নারী ও পুরুষ দালাল। কোনো রোগী এলেই ঘিরে ধরে এসব দালাল। এরপর ডাক্তার দেখানো ও প্যাথলজি টেস্টের নামে হাতিয়ে নেয় বাড়তি টাকা। এ কারণে গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই। সরকারি এ হাসপাতালটিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা থাকলেও পদে পদে গুনতে হয় টাকা।
উন্নয়ন কাজেও হরিলুট : ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আওতায় ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে হাসপাতাল সংস্কারের জন্য মেসার্স হালিমা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানকে ১৫০ দিনের মধ্যে হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে রঙ করা, দরজা-জানালার সার্টার, গ্লাস পরিবর্তন ও মেরামত করাসহ ৫৬টি আইটেমের কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু শুধু ইউএইচওর কক্ষে টাইলস ফিটিং ও ভেতরে-বাইরে চুনকাম করা ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তা, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিলে মাত্র দুই থেকে তিন লাখ টাকার কাজ করে পুরো টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
আরএমও ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : হাসপাতালের আরএমও মমিনুল হক ও তার স্ত্রী মেডিকেল অফিসার আফসানা হোসেন শাওনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে তাড়াইল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও ৩ জন ইউপি চেয়ারম্যানসহ অন্তত ১০ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (প্রশাসন) বরাবরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
অভিযোগে জানা গেছে, মমিনুল হক তাড়াইল বাজারের বাসিন্দা মৃত আইনুল হকের ছেলে মমিনুল হক ও তার স্ত্রী আফসানা হোসেন শাওন ২০১০ সালের ১ জুলাই মেডিকেল অফিসার হিসেবে এখানে যোগদান করেই এ দুজন হাসপাতাল চলাকালীন সময়ে বাসায় প্রাইভেট চেম্বারে বসে ফি নিয়ে রোগী দেখে আসছেন। তারা টাকা ছাড়া কোনো রোগীর চিকিৎসা করেন না। টাকা না দিলে রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে অসদাচরণ করেন এবং চিকিৎসা করেন না। প্রায় ৭ মাস আগে হাসপাতালের আরএমওর দায়িত্ব পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তবে, এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডাক্তার মমিনুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি সব সময় রোগীদের সাধ্যমতো সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। এটা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। একই কথা বললেন, মেডিকেল অফিসার আফসানা হোসেন শাওন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এহসানুল হক মুকুল বলেন, লোকবল ও নার্স না থাকায় চিকিৎসা নিতে আসা বিপুলসংখ্যক রোগীকে সেবা দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ফি আদায় ও রোগীদের সঙ্গে অসদাচরণ সঠিক নয় জানিয়ে তিনি বলেন, রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবাইকে ওষুধ দেয়া সম্ভব হয় না। আর রোগীদের খাবারের মান সম্পর্কে লক্ষ্য রাখা হবে। আরএমও ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা নেবেন। সংস্কার কাজের অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের আমাদের নয়। কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মৃণাল কান্তি বলেন, তাড়াইল হাসপাতালের ডাক্তারদের অনিয়ম ও চিকিৎসাসেবায় অবহেলার অভিযোগ শুনেছি। অনিয়মের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.