ইয়াহু-প্রজাতি এবং বাংলাদেশের জনগণ by কাজী সাইদ

৫ জানুয়ারি ২০১৪ একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আরেক মেয়াদের জন্য ক্ষমতাকে নবায়ন করেছে মাত্র। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ম্যান্ডেটের তোয়াক্কা করেনিÑ ভোটদাতাদের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি দেখানো হয়েছে চরম অবজ্ঞা। সরকার গঠনের জন্য যেখানে প্রয়োজন ১৫১টি আসন, সেখানে ভোটের আগেই ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী। এমন একটি সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে কার্যত বিরোধী দল বলতে কিছুই নেই। দাঁড়কাককে ময়ূরের পুচ্ছ পরিয়ে ময়ূর বলে চালিয়ে দেয়ার এ যেন এক ব্যর্থ কসরত। আসন ভাগাভাগির এ কূটকৌশলের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে গঠিত সরকারকে যত শিগগির সম্ভব একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে বাধ্য করার দাবিতে গত ৬ জানুয়ারি ’১৫ থেকে দেশব্যাপী টানা অবরোধ। সাথে যুক্ত থাকছে হরতাল। ২০ দলীয় জোট নেত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অনির্দিষ্টকালের এ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন। তার সুনির্দিষ্ট দাবির প্রতি সরকারের কোনো ধরনের ভ্রƒক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। সরকারের টপ টু বটম কর্তাব্যক্তিরা দাবি করছেন বিরোধী জোটের এ আন্দোলনের সাথে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেইÑ এগুলো স্রেফ জঙ্গি তৎপরতা, নাশকতা। বিএনপি-জামাত সন্ত্রাসী দল, এদের নির্মূল করতে হবে সংবিধান-গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে।
ইতিমধ্যে বেগম জিয়া ‘হুকুমের আসামি’ করে মামলা রুজু করা হয়েছে। মঈনু-ফখরুদের রুজু করা খালেদার মামলাগুলোর বিচারকাজে গতি সঞ্চার করা হয়েছে।। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে নাজিম উদ্দীন রোডে পাঠানোর কথা বলছেন, তার দলের এক হাইব্রিড নেতা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেগম জিয়াকে বাকি জিন্দেগি কারাগারে কাটাতে হবে। অবরোধ আর হরতালের প্রভাবে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য লাটে উঠেছে, শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন ককটেল-পেট্রলবোমায় ‘জনগণ’ হতাহত হচ্ছে, যানবাহন পুড়ছে, যৌথবাহিনীর অভিযানে বাড়িঘর ছাড়া হচ্ছে, কারেন্ট জাল দিয়ে জাটকা ধরার মতো সারা দেশে হাজার হাজার মানুষকে একাধিক নাশকতার মামলায় আটক দেখিয়ে জেলে পুরা হচ্ছে। দেশজুড়ে জনমনে আতঙ্ক দিন দিন বেড়েই চলেছে। গুম, খুন, লাশ হওয়ার আতঙ্কে ভুগছে ‘জনগণ’। জনগণ যেন আজ জনাথন সুইফটের সেই ইয়াহু প্রজাতি।
পাঠক, চলুন ঘুরে আসি সুইফ্টের সময়ের ইংল্যান্ডে, চোখ ফেরাই লেমুয়েল গালিভারের ‘ভয়েজ টু গালিভারের’ দিকে।
জনাথন সুইফটের গালির্ভাস ট্র্যাভেলস
বিশ্বখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক জনাথন সুইফট (১৬৬৭-১৭৪৫ইং) নিজের ভাগ্য বিড়ম্বনা এবং মানব সমাজের তিক্ত অভিজ্ঞতার ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা করেছিলেন ১৭২৬ সালে লেখা তার কাল্পনিক ভ্রমণ কাহিনী গ্রন্থ গালিভার্স ট্র্যাভেলসে। পাঠক এ পুস্তকটিকে ‘রবিনসন-ত্রুশো’র মতো একজন বীরের আনন্দময় ভ্রমণকাহিনী হিসেবে বিবেচনায় আনলেও এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য এবং এর প্রভাব সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। লেমুয়েল (Lamuel) গালিভার চারটি অদ্ভুত দেশে ভ্রমণ করেছিলেন পর্যায়ক্রমে। প্রথম ভ্রমণে লিলিপুটে (Lilliput) বৈরী আবহাওয়ায় পড়ে তার জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখানকার অধিবাসীদের তিনি দেখতে পেলেন তার বৃদ্ধাঙ্গুলির দৈর্ঘ্যরে সমান পরিমাণের। তাদের সব কর্মকাণ্ড এবং উদ্দেশ্য খর্বাকৃতির। তাদের নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া বিবাদ মানবতার সঙ্কীর্ণতারই প্রতিফলন। সে দেশের দুটো বড় দল ‘লিটল ইন্ডিয়ানস’ এবং ‘বিগ্ ইন্ডিয়ানস’ এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সঙ্ঘাত দেশে গৃহযুদ্ধাবস্থা অব্যাহত রেখেছে। এর কারণ হচ্ছে ডিমের মাঝখান দিয়ে ভাঙা হবে নাকি এর প্রান্ত দিয়ে। অর্থাৎ, একদল ডিমের মাঝখান দিয়ে ভাঙার পক্ষে, অন্য দল ডিম ভাঙবে প্রান্ত দিয়ে। সুইফ্ট এ ব্যঙ্গাত্মক কল্পকাহিনীর মধ্য দিয়ে তার সময়কার ইংল্যান্ডের ‘টোরি’ এবং ‘হুইগস্’ এ দুটো বড় রাজনৈতিক দলের বিরোধ এবং তার জেনারেশনের প্রকৃত অবস্থাকেই বুঝাতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় সফরে তিনি ব্রবডিংনাগ (Brobdingnag) উপনীত হয়ে দেখতে পেলেন সেখানকার অধিবাসীরা অতিশয় দীর্ঘাকৃতির এবং তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডও অসম্ভব রকমের বৃহদাকৃতির। মানবতার সঙ্কীর্ণতার ব্যাঙ্গাত্মক এ উপস্থাপনা বিবেককে নাড়া দেয়ার মতো। গালিভার যখন ব্রবডিংনাগবাসীদের তার নিজ দেশের জনগণের উচ্চাকাক্সা, যুদ্ধ এবং বিজয়ের কাহিনী বর্ণনা করছিলেন তখন অতিশয় দীর্ঘকায় লোকগুলো আশ্চর্য হলো এই ভেবে যে, এসব ুদ্রকীটের ভেতর কেমন করে মারাত্মক প্রাণসংহারী বিষ ছড়িয়ে থাকতে পারে।
তার তৃতীয় সফরটি ছিল লেপুটায় (LAPUTA)। তার এ ‘ভয়েজ টু লেপুটা’ ছিল মূলত সব শিক্ষিত, বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের প্রতি দারুণ বিদ্রƒপ। লেপুটা ছিল একটি উড়ন্ত দ্বীপ যা ওজনদার পাথরের সাহায্যে বাতাসে স্থাপিত। বিখ্যাত লাগাডো (Lagado) অ্যাকাডেমির প্রফেসররা সেই বায়বীয় সংবিধানের অধীন। আট বছর যাবৎ সেখানকার দার্শনিকেরা গবেষণা করে যাচ্ছে কেমন করে শফা থেকে সূর্যালোক বের করা যায়। এখানে তিনি সমস্ত বৈজ্ঞানিক সমস্যাকে ব্যঙ্গ করেছেন। এ সফর থেকে আমরা জানতে পারি স্ট্রাল্ডবার্গস (STRULDBVRGS) নামে এক মনুষ্যপ্রজাতি আশাহত এবং জীবনের আকাক্সা ত্যাগ করে ধ্বংস হয়ে পৃথিবীতে বসবাস করতে শুরু করেছে। স্থান তিনটি সফরের বর্ণনার মধ্য দিয়ে জনাথন সুইফ্ট মানুষের আচারব্যবহার এবং প্রথার মাধ্যমে নিজেদের আত্মপ্রতারণা এবং মানবতাবোধের নৃশংস দোষগুলোকেই প্রকাশ করে দিয়েছেন।
সুইফ্ট তার চতুর্থ সফরের মধ্য দিয়ে বিদ্রƒপের যৌক্তিক চূড়ান্তপর্যায়ে চলে এসেছিলেন। তার ‘ভয়েজ টু হুন হুইম্স (Houyhnhnms) মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য যেন এক মারাত্মক অস্ত্র। লেমুয়েল এ দেশে এসে দেখলেন, শাসক জানোয়ারদের তুলনায় সেখানকার ঘোড়াগুলো উচ্চমার্গের এবং বুদ্ধিমান জীব। সেখানে ইয়াহু (yahoo) নামে এক ভীতিপ্রদ প্রজাতি রয়েছে যাদের শারীরিক গঠন এবং অবয়ব মানুষের মতো, কিন্তু অবর্ণনীয় অবহেলায় (degradation) তারা জীবন ধারণ করছে।
সুইফটের ইংল্যান্ড
ইংরেজি সাহিত্যে অষ্টাদশ শতাব্দী বলতে ১৭০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত সময় কালকে বুঝানো হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু ১৬৮৯ সালে ‘বিল অব রাইটস’ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এ বিখ্যাত বিলটি ছিল ইংল্যান্ডে সাংবিধানিক সরকার গঠনের তৃতীয় এবং শেষ ধাপ। প্রথম ধাপটি ছিল ১২১৫ সালের ‘গ্রেট চার্টার’ এবং দ্বিতীয়ধাপটি ছিল ১৬২৮ সালের ‘পিটিশন অব রাইটস।’ ইংল্যান্ডে আধুনিক কেবিনেট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজা প্রথম জর্জের রাজত্বে ১৭২১ সালে, ওয়ালপোল (Walpole) হচ্ছেন ইংল্যান্ডের প্রথম প্রধানমন্ত্রী।
রাজনৈতিকভাবে ইংল্যান্ড তখন দু’টি বিবদমান দলে বিভক্ত। হুইগ্স (Whigs) এবং টোরিস (Tories)। হুইগরা ছিল জনগণের বৃহত্তর অধিকারের (Liberty) পক্ষে; টোরিরা সমর্থন করছিল জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজার ক্ষমতা চর্চার। দু’দলের বিপরীতমুখী অবস্থান ছিল সঙ্ঘাতপূর্ণ যা ইংরেজ জাতির নৈতিক ভিত্তিকে করেছিল নি¤œগামী, রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তদের রাহাজানি শহরগুলোতে ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, ঘুষ-দুর্নীতিই ছিল রাজনীতিকদের একমাত্র নীতি, সমাজে মদ্যপানের উপস্থিতি ছিল রীতিমতো ভীতিজনক। সুইফ্ট-এর ইয়াহু-প্রজাতি তৎকালীন ইংল্যান্ডের নাগরিকদেরই প্রতিচ্ছবি।
বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা
দেশের বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী কিছুসংখ্যক তথাকথিত শিক্ষিত লোকজন। ছোটকালের একটি সদুপদেশ ছিল- 'Money Lost nothing Lost, Health Lost something Lost, Character Lost everything Lost.' অর্থাৎ, ‘অর্থনাশ কোনো’ ক্ষতিই নয়, স্বাস্থ্যের অধোগতি কিছুটা ক্ষতিই বটে, চরিত্র হারানো মানে সব কিছুই হারানো। ইসলাম বলে, ‘যার লজ্জা নাই তার ঈমানই নাই।’
অর্থ, প্রতিপত্তির লোভ-লালসা আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র, সমাজ থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। সর্বত্র মিথ্যার বেসাতি। ক্ষমতাবানেরা এবং ‘চাটার’রা লজ্জাশরমের ধারেপাশেও ঘেঁষতে চায় না। চরিত্রহীনদের কাজই হলো অপরের চরিত্র হনন। নির্বাচনের নামে গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণের পর বাকি রইল কী? জাতিসঙ্ঘ, দাতা-রাষ্ট্র যতই বলুক, দেশের স্থিতিশীলতা, সমৃদ্ধি, মানবাধিকার রক্ষা, গণতন্ত্রের বিকাশে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি করাÑ আমরা বলি, সর্বাগ্রে প্রয়োজন ক্ষমতাসীনদের মাইন্ডসেট পরিবর্তন। সেটা কী? ‘নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন ও প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী মো: নাসিম এমপি বলেছেন, ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনা আবারো প্রধানমন্ত্রী হয়ে নাটোরের ছেলে তাইজুলের মতো হ্যাটট্রিক করবেন। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে চক্রান্ত করলে খালেদা জিয়ার কালোহাত ভেঙে দেয়া হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখাবেন না। আন্দোলন কাকে বলে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ডাকা হয়েছিল আসেন নাই। ১৯ সালের আগে আর কোনো সংলাপ বা নির্বাচন হবে না। সে সময় সংলাপ হলেও বিএনপির সাথে হবে না।’ (নয়া দিগন্ত, ২ ডিসেম্বর ২০১৪) ১৪ দল এখন ক্ষমতাসীন। জনাব নাসিম দলগুলোর সমন্বয়ক।
নির্বাচন করতে যে জনগণের দরকার হয় না তা এদেশের জনগণকে ৫ জানুয়ারি ১৪ দল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়। বাংলাদেশের ‘জনগণ’ এখন ইয়াহু-প্রজাতির মতোই অসহায়।
kazi_sayed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.