রিমান্ডের রেকর্ড- উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশনা by কাজী সুমন

৩০শে জানুয়ারি রাতে গুলশানের একটি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে। ১লা ফেব্রুয়ারি তাকে হাজির করা হয় আদালতে। বাড্ডা থানায় দায়ের করা একটি মামলায় তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এরপর একে একে বিভিন্ন মামলায় এখন পর্যন্ত ২৭ দিন রিমান্ড ভোগ করেছেন তিনি। রিজভী আহমেদ একা নন। গত দু’মাসে গ্রেপ্তার হওয়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বেশির ভাগকেই রিমান্ডে যেতে হচ্ছে। রিমান্ডের ক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নানা রেকর্ড। বাংলাদেশে রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ অবশ্য পুরনো। এ নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনাও রয়েছে। তবে এ নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিদিনই। মানছেন না কেউই। যদিও মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে বহুলাংশেই অনুসরণ করা হয় ওই নির্দেশনা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ড. শাহদীন মালিক এ ব্যাপারে বলেন, ‘বাংলাদেশে সব জায়গায় নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে অভিযুক্তদের কোন সাংবিধানিক বা আইনগত অধিকার নেই বললেই চলে। মন্টেস্কু ক্ষমতার পৃথকীকরণের কথা বলেছিলেন যেন অভিযুক্ত তার অধিকার পায়। কোন দেশে যদি অভিযুক্ত তার অধিকার না পায় তবে সে দেশে গণতন্ত্র আছে- তা বলা যাবে না।’ ড. মালিক বলেন, ‘রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের বিচারকরা হাইকোর্টের নির্দেশনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করছেন না। নিয়তির পরিহাস এই যে, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তরা হাইকোর্টের নির্দেশনার সুফল ভোগ করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক কর্মীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না।’
রিমান্ডের পর রিমান্ড:  গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানীর একটি বাসা থেকে আটক করা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। একদিন পরে তাকে হাজির করা হয় আদালতে। এসময়  সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহে উস্কানির চেষ্টা ও প্ররোচনার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তার বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। আদালত ১০ দিনের রিমান্ডই মঞ্জুর করে।  ওই ১০ দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ার পর গত ৭ই মার্চ ফের আদালতে হাজির করা হয় সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতাকে। ওই দিন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দায়েরকৃত একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দফা ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। আদালত ১০ দিনের রিমান্ডই মঞ্জুর করে। গত ৬ই জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। পরদিন পল্টন থানার একটি গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। তবে শুনানি শেষে বিচারক রিমান্ড এবং জামিনের দুটি আবেদনই নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। পরে অবশ্য চারদফায় ১২ দিন রিমান্ড ভোগ করেন মির্জা আলমগীর। পল্টন থানায় গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে দায়েরকৃত একটি মামলায় ৩ দিন, রাজধানীর মতিঝিল থানায় করা একটি মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এরপর আরও দু’দফায় ২ দিন করে ৪ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর নানা রাজনৈতিক তিক্ততার মধ্যেও গণতান্ত্রিক শাসনের সময় সাধারণত প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিবকে কখনওই গ্রেপ্তার করা হয়নি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ক্ষেত্রেই প্রথম সে রীতি ভঙ্গ করা হয়। এখন তাকে রিমান্ডেও যেতে হচ্ছে।  গত ৮ই জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রমকে। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে রাজধানীর বংশাল থানায় নাশকতার অভিযোগে দায়েরকৃত একটি মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ১লা ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে আটক করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন (এ্যাটকো)-এর সভাপতি মোসাদ্দেক আলী ফালুকে। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় তিন দফায় তাকে ১৩ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়। ২রা ফেব্রুয়ারি খিলগাঁও থানায় দায়ের করা গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মামলায় ৫ দিন, ৭ই ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক আইনে বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলায় ৩ দিন ও ১১ই ফেব্রুয়ারি অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণ মামলায় ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গত ১১ই জানুয়ারি রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুুদুকে। এরপর কয়েকদফা অন্তত দুই সপ্তাহ রিমান্ড ভোগ করেন সাবেক এই ছাত্রনেতা। ১২ই জানুয়ারি মিরপুর থানার একটি মামলায় ৫ দিন, ২৮শে জানুয়ারি একই থানার আরেকটি মামলায় ২ দিন এবং মিরপুর থানায় দায়েরকৃত আরেকটি মামলায় তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। ১২ই জানুয়ারি গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়  বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহানকে। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে অগ্নিসংযোগ ও গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। ১৮ই জানুয়ারি গুলশানের একটি বাসা থেকে বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ও রাজশাহী জেলা সভাপতি নাদিম মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। শুনানি শেষে ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি গুলশান কার্যালয়ের সামনে থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সেলিনা সুলতানা নিশিতাকে আটক করে পুলিশ। পরদিন তাকে আদালতে হাজির করে শাহজাদপুর এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের করা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এদিকে রাজনীতিবিদ ছাড়াও গণমাধ্যম ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়। গত ৫ই জানুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার করা হয় বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে। এরপর তাকে আদালতে হাজির করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। গত ৩রা মার্চ গ্রেপ্তার করা হয় একুশে টেলিভিশনের সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার কনক সারওয়ারকে। তিনি একুশে টেলিভিশনের প্রচারিত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘জনতার মঞ্চ’-এর উপস্থাপক ছিলেন। শুধু গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ, পরদিন পর্নোগ্রাফির একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৫ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয় তাকে। ২১শে ফেব্রুয়ারি  মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার একটি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এসএসসি পরীক্ষার্থী  ও ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির রফিকুল ইসলাম খানের ছেলে রিফাত আবদুল্লাহ খান। এরপর তাকে আদালতে হাজির করে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। ওই  রিমান্ড শেষে ফের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় পুলিশ। আদালত আবারও ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।
উপেক্ষিত হাইকোর্টের নির্দেশনা: সন্দেহজনক গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারার অপব্যবহারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)সহ আরও কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ২০০৩ সালের ২৭শে এপ্রিল হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ দুটি বিষয়ে প্রচলিত আইন সংশোধনের নির্দেশ দেয়। আইন সংশোধনের পূর্বে হাইকোর্টে কয়েক দফা নির্দেশনা মেনে চলারও নির্দেশ দেয়। যে নির্দেশনা আপিলও বিভাগও স্থগিত করেনি।  হাইকোর্টের নির্দেশনায় বলা হয়, ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। খ. কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. গ্রেপ্তারের কারণ একটি পৃথক নথিতে পুলিশকে লিখতে হবে। ঘ. গ্রেপ্তারকৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে তার কারণ লিখে তাকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে ডাক্তারি সনদ আনবে পুলিশ। ঙ. গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের এর কারণ জানাতে হবে। চ. বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেপ্তারকৃতদের নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার মধ্যে টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ছ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে তার পছন্দসই আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। জ. গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাঁচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। ঝ. কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া না গেলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে সর্বোচ্চ তিনদিন পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। ঞ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে দ বিধির ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে। ঠ. পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। ড. পুলিশ বা কারা হেফাজতে কেউ মারা গেলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্তের ব্যবস্থা করবেন। মৃত ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্তে বা তদন্তে যদি মনে হয় ওই ব্যক্তি কারা বা পুলিশ হেফাজতে মারা গেছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট মৃত ব্যক্তির আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দিবেন।

No comments

Powered by Blogger.