স্টিয়ারিং কন্যা by রাশিম মোল্লাহ

পেশাদার গাড়িচালক ছবি: শাহীন কাওসার
সময়ের পরিবর্তনে চ্যালেঞ্জিং সব পেশায় যুক্ত হচ্ছেন নারীরা। গাড়ির ড্রাইভিং সিটে নারীদের বসলে একসময় অবাকদৃষ্টিতে তাকাতো সবাই। এখন সেই নারীরাই পেশাদার চালক হিসেবে গাড়ি চালাচ্ছেন রাস্তায়। দেশে এখন মহিলা ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্র্যাক স্কুল ড্রাইভিং থেকে এ পর্যন্ত কয়েক শ’ মহিলা চালক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেক মহিলাই গাড়িচালক হিসেবে বেশ নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে মহিলা ড্রাইভারদের দেখা না গেলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশী এনজিওতে গাড়ি চালাচ্ছেন অনেকে। নারায়ণগঞ্জের ববিতা রানী দাস। ২০০০ সালে এসএসসি ও ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। ছোট বয়সেই বাবাকে হারান। এক ভাই আর মাকে নিয়ে তার সংসার। ভাই উত্তরা আজমপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়াশোনা করেন। রাস্তায় চলতে গিয়ে ববিতা দুবার দুর্ঘটনার শিকার হন। প্রথম ফুফুরবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় নরসিংদীর বেলানগর এলাকাতে গাড়িটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ওই দুর্ঘটনায় ১৫ জন নিহত, তিনিসহ অনেকে আহত হন। ওই দুর্ঘটনার এক বছর পরে তিনি চিকিৎসার জন্য যাত্রাবাড়ীতে আসার পথে আবার দুর্ঘটনায় পতিত হন। সে সময় তিনি মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পান। এ ঘটনার পরপরই ববিতা ফুফুর পরামর্শে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ শুরু করেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে ববিতা সফল হয়ে ফিরে যান গ্রামের বাড়িতে। এবার পালা চাকরি খোঁজার। এমনই একদিন চাকরি মিলে উত্তরায়। বাড়ির গৃহকর্তা তাকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। তার কাজ ছিল মেয়েকে স্কুলে আনা-নেয়া। ১১ মাস পর যোগ দেন নেদারল্যান্ডসের অর্থায়নে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলাপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ বাংলাদেশ নামে একটি বিদেশী এনজিওর চালক হিসেবে। কর্মস্থল হয় বরিশাল এলাকায়। মাসের প্রায় ২০ দিনই ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথে গাড়ি চালাতেন ববিতা। প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবাই তার গাড়ির ড্রাইভিংয়ে বেশ সন্তুষ্ট। সব মিলে মাসে ১৪ হাজার ১৪২ টাকা বেতন পান। এর আগে ববিতা কাজ করতেন ব্র্যাকের একটি স্বাস্থ্য প্রজেক্টে।
খুলনার আফসানা মিমি। এসএসসি পাস করার পর আর্থিক অনটনের কারণে আর পড়ালেখা করতে পারেননি। ছোট দুই বোনের মধ্যে তিশা নামের বোন একাদশ শ্রেণীতে, আরেক বোন অষ্টম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। ছোট ভাই মিরাজ হাওলাদার মাদরাসার ছাত্র। বাবা কোন কাজকর্ম করতে পারেন না। মায়ের চিকিৎসা বাবদ প্রতি মাসে ব্যয় হয় প্রায় হাজার টাকা। তিনি ও তার ছোট ভাই চাকরি করেন। ভাই-বোনের বেতনে চলে সংসার। এমনই এক পরিস্থিতিতে ২০১২ সালে মিমি একটি ড্রাইভিং স্কুল থেকে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে যোগ দেন ব্র্যাক ব্যাংকের প্রাইভেট কারচালক হিসেবে। সবমিলে মাসিক বেতন ধরা হয় ১১ হাজার টাকা। মহাখালী এলাকায় কয়েকজন গার্মেন্টকর্মীর সঙ্গে একটি বাসাভাড়া নিয়ে থাকেন তিনি।
নাসরিন খাতুন, গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে। তারা পাঁচ বোন, চার ভাই। ভাই-বোনদের মধ্যে নাসরিন সবার ছোট। ছোটবেলায় তিনি বাবাকে হারিয়েছেন। ২০১১ সালে এসএসসি পান করেন নাসরিন। এরপর আর্থিক সঙ্কট দেখা দিলে ২০১২ সালে একটি ড্রাইভিং স্কুলে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে যোগ দেন ব্র্যাক ব্যাংকের গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে। মাসিক বেতন ধরা হয় ১১ হাজার টাকা। এখন তিনি শেরেবাংলা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একাদশ শ্রেণীতে পড়াশোনা করছেন। নাসরিন জানান, চ্যালেঞ্জিং হলেও পেশাকে তিনি উপভোগ করছেন বেশ। তিনি জানান, নারীকর্মী হিসেবে পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে বেতন-বৈষম্য রয়েছে তাদের। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ড্রাইভিং পেশাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে এটি নারীর ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। এ পেশাতে নারীরা আসার কারণে নারীদের নিরাপত্তা বাড়বে। আগে অনেক বাসাবাড়ি কিংবা অফিস-আদালতে মহিলা ড্রাইভার দরকার হলে পাওয়া যেত না। এখন যেহেতু নারীরা এ পেশাতে আসতে শুরু করেছেন, তাই মহিলা যাত্রীদের আর পুরুষ ড্রাইভারের ওপরে নির্ভরশীল হতে হবে না। মহিলা-পুরুষ চালকদের মধ্যে যেন কোন বেতন-বৈষম্য না হয় সে ব্যাপারে চাকরিদাতাদের সজাগ থাকার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ২০১২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার ৯৭৭ নারী চালক লাইসেন্স নিয়েছেন। এর মধ্যে অপেশাদার লাইসেন্স নিয়েছেন ১১ হাজার ৬৬৮। আর পেশাদার নারী চালক হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছেন ৩০৯। ৩০৯ জন পেশাদার নারী চালকের মধ্যে ভারি গাড়ি চালনার লাইসেন্স নিয়েছেন মাত্র দুজন। মিডিয়াম গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দুজন, লাইট (জিপ, কার, মাইক্রোবাস) ২৮৬, মোটরসাইকেল চালনার লাইসেন্স ১৮ এবং থ্রি হুইলার চালনার লাইসেন্স নিয়েছেন একজন।

No comments

Powered by Blogger.