রেলকর্মী যখন ফিশপ্লেট খুলে নেয় by জাবেদ রহিম বিজন

স্বাভাবিক দুর্ঘটনাকে অস্বাভাবিক বানাচ্ছে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বর্তমান সময়ে যেকোন কারণে রেলের বিচ্যুতিকে ‘নাশকতা’ বলে প্রতীয়মান করতে তৎপর এরা। নিজেদের দায় ঢাকতে ‘নাশকতা’ এখন পুঁজি তাদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উপকূল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুতির ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছে তাদের এই প্রবণতা; যা তোলপাড় সৃষ্টি করেছে রেল বিভাগে। জিআরপি পুলিশ ও অন্যান্য দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন পুনিয়াউট রেলক্রসিং এলাকায় ৫ই মার্চ বেলা পৌনে ১১টায় লাইনচ্যুত হয় নোয়াখালী থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপকূল এক্সপ্রেস। এর ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হন রেলপথ দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা আর কর্মীবাহিনী। তারা এসেই বলতে শুরু করেন এটি নাশকতার কারণে হয়েছে। একটি জায়গা দেখিয়ে তারা বলেন, দেখেন এখানকার ফিশপ্লেট খুলে নেয়া হয়েছে। তখনই জিআরপির সদস্যরা তাদের বলেন, এই ফিশপ্লেটটি আপনাদের লোকই কিছুক্ষণ আগে খুলে নিয়ে গেছে। তারা হোসেন নামে ওই কর্মীর নামও জানায়। এরপরই চুপ হয়ে যায় রেলপথ দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীবাহিনী। ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ার মিনিট বিশেকের মধ্যেই ফিশপ্লেটটি খুলে ফেলা হয়।  জিআরপি পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিষয়টি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। উপকূলের লাইনচ্যুতির পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন মাস্টার মো. মহিদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে রেললাইন ত্রুটির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পরপরই ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে রেলের ঊর্ধ্বতন আটজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে আসেন তদন্ত করতে। আখেরে এই দুর্ঘটনা রেললাইনে ত্রুটির কারণে হয়েছে বলে নিরূপণ হয়। সহকারী প্রকৌশলী-পথ কাজী মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, গাড়ি ও লাইনের দোষে উপকূল লাইনচ্যুত হয়েছে। চাকার ক্লিপ লুজ ছিল। এর হুইল ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল। আর লাইনের কিছু অংশ লুজ ছিল। এর আগে গত ২৫শে জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাঘাচংয়ে সিলেট থেকে ঢাকাগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসের ৬টি কোচ লাইনচুৎতির ঘটনাটিকেও ‘নাশকতা’ বলে চালিয়ে দেয় রেল কর্মকর্তারা। জয়ন্তিকা লাইনচ্যুতির পরই ঘটনাস্থলে ছুটে যাওয়া মানুষ প্রত্যক্ষ করেন পচা স্লিপার। স্লিপার রেলের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকানো নেই। ঘটনার পরপরই পাঘাচং রেলস্টেশন মাস্টার এবং রেলপথ ঠিকঠাক করার কাজে নিয়োজিত একাধিক শ্রমিক সাংবাদিকদের জানান, রেলের দুরবস্থার কারণেই এই দুর্ঘটনা। তারা বলেন, স্লিপারের কাঠগুলো পচা ছিল। এগুলো সাপোর্ট রাখতে পারেনি। তাছাড়া স্লিপারের সঙ্গে আটকানোর ক্লিপও ছিল না। ওই ঘটনায় বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থলে এসেই ‘নাশকতা’ বলে তাদের মত ব্যক্ত করেন। তখন স্থানীয় লোকজন এর প্রতিবাদ করেন। তারা তদন্ত কমিটির সদস্যদের টেনে নিয়ে রেলপথের দুরবস্থা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। এই দুর্ঘটনার ৩ দিন পর ঘটনাস্থলে মেরামত কাজ পরিদর্শন করতে আসা বিভাগীয় প্রকৌশলী ও তদন্ত কমিটির একজন সদস্য মো. আরমান হোসেনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তখন তিনি বলেন, ঘটনাটি নাশকতার কারণে হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। ফিশ-বল্টু খুলে রাখার প্রমাণ তারা পেয়েছেন। দুর্ঘটনাটি নাশকতা বলে কর্মকর্তাদের এমন মন্তব্যে তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পাঘাচং গ্রামের মানুষ। সফিক মিয়া নামের এক বৃদ্ধ বলেন, রেললাইন বসানোর পর আজ পর্যন্ত আর ঠিক করা হয়নি। তিনি বলেন, নাশকতা হবে কিভাবে। ওইদিন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে দুপুরে। এর আগে আরও ১০-১২টি ট্রেন এই পথ দিয়ে চলাচল করেছে। সেগুলোর কিছু হলো না, জয়ন্তিকা পড়ে গেল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আখাউড়া জিআরপি থানার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, রেলের অসাধু কর্মচারীদের এই প্রবণতা ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা নরমালি কোন দুর্ঘটনায় ফিশপ্লেট বা লাইনের কিছু একটা খুলে দুর্ঘটনার কারণ নাশকতা বলছে। লাইনের এটা-ওটা মিসিং দেখাচ্ছে। আর সে কারণে এটি নাশকতা হয়েছে বলে বক্তব্য দিতে শুরু করে । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উপকূল লাইনচ্যুত হওয়ার পর রেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজনের কাছে বিষয়টি হাতেনাতে ধরা পড়েছে। পাঘাচংয়ের ঘটনা ও লাইনের দুরবস্থার কারণেই হয়েছে বলে জানান জিআরপির ওই কর্মকর্তা। ৫ই মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন এলাকার ৪ নম্বর লাইনে উপকূল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়। এই লাইনটির দুরবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। এই তথ্য জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, এক নম্বর লাইনটি হেঁটে দেখে আসুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন কি অবস্থা। তার আশঙ্কা এই লাইনটিতেও যেকোন সময় ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রায় ৭৩ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এই পথের সর্বত্রই দুর্দশার ছাপ। পাথর নেই, স্লিপার নেই। ক্লিপ নেই। স্লিপারের সঙ্গে ক্লিপ আটকানো নেই। পাঘাচং গ্রামের মো. আশিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, শুধু আমাদের এখানে নয়  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যেখানে যাবেন সেখানেই লাইনের দুরবস্থা দেখবেন। এগুলো মেরামতের দায়িত্ব রেলওয়ের পথ ও পূর্ত বিভাগের। কিন্তু তারা কোন কাজই করে না বলে রেলপথবর্তী এলাকার মানুষের অভিযোগ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুনিয়াউটের খন্দকার শফিকুল আলম বলেন, আগে রেললাইনে শ্রমিকরা কাজ করছে, পাথর ছড়িয়ে দিচ্ছে, স্লিপার ঠিক করছে- দেখতে পেতাম। এখন এই দৃশ্য বিরল। আখাউড়া রেলজংশনে বসেন পথ ও পূর্ত বিভাগের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী মোস্তাফিজুর রহমান। গত দু-দিন ধরে এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করি তার সঙ্গে।  তিনি ফোন রিসিভ করে ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। রেল ও রেলপথের নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ও সাধারণ লোকজনের অভিযোগ কাজ না করে রেলের এই বিভাগ টাকা মেরে দিচ্ছে। আর দুর্বল লাইনে ট্রেন পড়লেই নাশকতার কারণ নিয়ে হাজির হচ্ছে তারা।

No comments

Powered by Blogger.