ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বিদেশপ্রীতি চড়ামূল্যে ওষুধ আমদানির নেপথ্যে

বাংলাদেশী ওষুধের সুনাম এখন দুনিয়াজোড়া। অথচ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চলছে উল্টোপথে। বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় এমন অনেক ওষুধ দ্বিগুণ বা তারও বেশি দামে আমদানি করা হচ্ছে বিদেশ থেকে। আর এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক। অভিযোগ রয়েছে, নিজের পছন্দের কোম্পানির মাধ্যমে ওষুধ আমদানির সুযোগ করে দিচ্ছেন তিনি। আর এ ক্ষেত্রে তিনি মানছেন না কোন নিয়মনীতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উন্নতমানের ওষুধ উৎপাদনে স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কিন্তু ঔষধ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তা লালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। নিয়ম অনুযায়ী, দেশীয় কোম্পানি কোন ওষুধ উৎপাদন করলে ওই ওষুধ আমদানির অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই। অথচ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর তা মানছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উচ্চমূল্যের ওষুধ আমদানিতে প্রথম ধাপে রয়েছে ধানমন্ডিতে অবস্থিত রোশ বাংলাদেশ লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। জানা গেছে, ক্যানসার প্রতিরোধকারী ওষুধ ত্রাসতুজুমা এ দেশের বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস ও টেকনোড্রাগস উৎপাদন করে থাকে। এর মধ্যে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের উৎপাদিত ত্রাসতুনিক্সের মূল্য ৯০ হাজার টাকা ও টেকনোড্রাগসের হেরটিনের মূল্য ৮০ হাজার টাকা। একই ব্র্যান্ডের ওষুধ হারসেপটিন বিদেশ থেকে আমদানি করে এ দেশে বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ দেশী কোম্পানির সঙ্গে বিদেশী কোম্পানির দামের পার্থক্য দ্বিগুণ। অন্যদিকে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের উৎপাদিত ফিলগ্রাস্ট ইনজেকশন দেশীয় বাজারে ২৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা একই ওষুধ নিওলাস্টের দাম পাঁচ হাজার টাকা। এদিকে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের জোলেরন পাঁচ হাজার পাঁচ শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালসের জোলেনিকও একই দামে বিক্রি হচ্ছে। একই ব্র্যান্ডের আমদানিকৃত ওষুধ নিওলাস্ট বিক্রি হচ্ছে ২৭ হাজার পাঁচ শ টাকায়।
দেশীয় ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদনের পরও একই ওষুধ বিদেশ থেকে কেন আমদানি করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক মুঠোফোনে বলেন, বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানি করলে অসুবিধা কোথায়। আমার চেয়ে আপনার দায়িত্ব বেশি? ডিজি হিসেবে আমার মাথাব্যথা বেশি। কোন ব্যক্তির কোম্পানিকে সুবিধা দেয়ার জন্য এটা করা হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রশ্নই আসে না। হারসেপটিন উৎপাদনের মূল কোম্পানি রোশ। তাদের ওষুধের ধারে-কাছেও আমাদের দেশের কোন কোম্পানি নেই। তাই দেশের জন্য ও রোগীদের জন্য যে ওষুধ ভাল সেটাই আমরা আমদানি করছি। নিয়মিত অফিস না করা প্রসঙ্গে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক বলেন, আপনার কিছু জানার থাকলে আমার অফিসে এসে কথা বলুন। ফোনে আপনার সঙ্গে কোন কথা বলতে পারবো না। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান মহাপরিচালক অফিসে খুব একটা সময় দেন না। দুপুরের খাবারের পর বা তার আগেও তিনি অফিস থেকে চলে যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে স্বাক্ষর করার কর্তৃত্ব কারও ওপর ন্যস্ত না করেই বিদেশে ট্যুরে চলে যান। ফলে বিদেশ থেকে ফিরে অফিসে যোগদান না করা পর্যন্ত পণ্য নিবন্ধন, মূল্য অনুমোদনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আটকে থাকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিজি জাহাঙ্গীর হোসেনের আমলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাজকর্মে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এখন নতুন ওষুধ অনুমোদন প্রক্রিয়া চরম আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মুখে পড়েছে। তার সময়ে ওষুধ অনুমোদন-সংক্রান্ত মাত্র দুটি ডিসিসি বৈঠক হয়েছে। দুটি মিটিংয়ের মধ্যে সময়ের পার্থক্য এক বছর। বৈঠক হওয়ার তিন মাস পর বৈঠকের কার্যবিবরণী বিতরণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বর্তমান মহাপরিচালক ভেজাল, নকল ও ভুয়া ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। অধিদপ্তরের দুর্নীতি নির্মূলে তিনি তেমন কোন পদক্ষেপ নেননি। সম্প্রতি তার এক কর্মকর্তা নকল ওষুধ উৎপাদনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটিকে উপেক্ষা করে কিছু পণ্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে আগ্রহের কারণে সরকার জাতীয় ওষুধ নীতিমালা হালনাগাদের পদক্ষেপ নেয়। খসড়া নীতিমালাও প্রস্তুত করা হয়। সংশ্লিষ্টরা নতুন ওষুধ নীতিমালা প্রকাশের জন্য অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কারণ নতুন নীতিমালায় অধিকতর জনবান্ধব, মানসম্পন্ন ওষুধপ্রাপ্তির অধিকতর নিশ্চয়তা ও স্থানীয় উৎপাদনশিল্পকে আরও উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছিল। ওই নীতি চূড়ান্ত ধাপে থাকলেও মহাপরিচালক পুরো প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে দেন।
এর আগে গত জানুয়ারিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র দেয়া থেকে শুরু করে ওষুধের ছাড়পত্র নবায়ন করা পর্যন্ত ১৩টি খাতে ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫০০ টাকা থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। এতে বলা হয়, ওষুধ উৎপাদনকারী বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তার অসাধু সম্পর্ক রয়েছে। ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের বিভিন্ন পর্যায়ে নজরদারির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি আছে। রাজনৈতিক প্রভাবে কমিটিগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। গবেষণা উপস্থাপনকালে টিআইবি জানায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয় কোন প্রকল্প স্থানান্তর বা হন্তান্তরের সময়। এ ক্ষেত্রে একেকটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র পেতে ৫ থেকে ১০ লাখ, লাইসেন্স নবায়নে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ, রেসিপি অনুমোদন ৪-৫ হাজার, ওষুধ নিবন্ধন ১ থেকে দেড় লাখ, ফয়েল ইনসার্র্ট, লেবেল অনুমোদন ৭-৯ হাজার, বকলিস্ট অনুমোদন ২ থেকে আড়াই হাজার, লিটারেচার অনুমোদন ৪-৫ হাজার, দাম নির্ধারণ ৫-৬ হাজার, ওষুধ রপ্তানির নিবন্ধন ও জিএমপি সনদ ২০-৩০ হাজার, নমুনা পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ ৬-৭ হাজার, ওষুধের লাইসেন্স ১০-১৫ হাজার ও ওষুধের লাইসেন্স নবায়নে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষের লেনদেন হয়।

No comments

Powered by Blogger.