ইসলাম ও মুক্তচিন্তার অধিকার by এবনে গোলাম সামাদ

এবনে গোলাম সামাদ
ইসলাম ধর্মে মুক্তচিন্তার অধিকার দেয়া হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ধর্মের নামে কোনো জবরদস্তি নেই (সূরা-২: ২৫৬)। একই সূরায় আরো বলা হয়েছে, যারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কিন্তু যুদ্ধের সীমা ছাড়াবে না। কেননা আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না (সূরা- ২: ১৯০)। সে সূরায় বলা হয়েছে, মুসলমানদের হতে হবে মধ্যপন্থী (সূরা- ২: ১৪৩)।
এ বিষয়ে ইসলামি ধ্যানধারণার সাদৃশ্য থাকতে দেখা যায় প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের (৩৮৪-৩২২ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) চিন্তাধারার। আল কুরআনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে (সূরা-৫: ৮০)। বলা হয়েছে, মানুষকে যুক্তির মাধ্যমে ধর্মের কথা বোঝাবে (সূরা-১৬: ১২৫)। এসব থেকে বোঝা যায় যে, ইসলাম একটি যুক্তিবাদী ধর্ম। এতে মানুষের মুক্তচিন্তার অধিকার আছে। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম আল গাজ্জালি বলেছেন কুরআনের সূরা নূরের ৩৫ নম্বর আয়াতের হতে পরে ৭০ হাজার রকম ব্যাখ্যা। অর্থাৎ আল কুরআনের বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। ইসলামে মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়নি। ইসলামে আল্লাহ হলেন সব সৃষ্টির অন্তিম ভিত্তি। আল্লাহ হলেন নিরাকার। সূরা নূরে বলা হয়েছে আল্লাহ হলেন আলোর আলো। অর্থাৎ এক পরম শক্তির উৎস। তাপ গতিবিদ্যার নিয়মানুসার তাপ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শীতল হয়ে যেতে পারত, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শীতল হয়ে যায়নি। অনেক বৈজ্ঞানিক তাই মনে করেন, শক্তির একটি অফুরন্ত উৎস আছে, মহাশক্তির এই উৎসই হচ্ছেন আল্লাহ। সব বৈজ্ঞানিক নাস্তিক নন। অনেক নামকরা বৈজ্ঞানিকই আস্তিক। যেমন আইজাক নিউটন, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টাইন প্রমুখ। তাই বিজ্ঞানের ইতিহাস বলে না যে, বৈজ্ঞানিক হতে হলে নাস্তিক হতেই হবে। কিন্তু মুক্তচিন্তাবাদীরা বোঝাতে চেয়েছেন যে, মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে হলে আস্তিক হওয়া যাবে না। আস্তিক্যবাদ মুক্তচিন্তার পরিপন্থী।
বিজ্ঞান বলে অকারণে কিছু ঘটে না। ধর্ম মানব জীবনে একটা বিরাট বাস্তবতা। ধর্মের উদ্ভবের মূলেও আছে নিশ্চয় কোনো-না-কোনো কারণ। কিন্তু মুক্তচিন্তাবাদীরা এই কারণকে খুঁজে দেখতে চান না। তারা বলতে চান, ধর্ম কেবলই হলো মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফল। যদিও আমরা দেখতে পাই ধর্ম ছিল এবং হয়ে আছে মানুষের নীতিচেতনার উৎস।
এসব কথা আমার মনে আসছে, কারণ সম্প্রতি অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার পর একদল বলছেন এর মূলে আছে ইসলামি মৌলবাদীদের হাত। কেবল তা-ই নয়, প্রমাণেরও চেষ্টা চলেছে। এরা বলে, আসলে ইসলাম হলো যুক্তিবুদ্ধিহীন মানুষের ধর্ম। কিন্তু তাদের বক্তব্য সত্য বলে ধরা যায় না। ইসলামের ইতিহাস এটা প্রমাণ করে না।
মুসলিম বিশ্বে এক সময় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা হয়েছে, এটা হতে পারত না, যদি ইসলাম হতো গোঁড়া একটা ধর্মবিশ্বাস। ইউরোপ ও আমেরিকায় এখন জ্ঞানবিজ্ঞানের হচ্ছে চর্চা। কিন্তু তা বলে ধর্মবিশ্বাসের বিলুপ্তি ঘটেনি। অনেকেই দিতে চাচ্ছেন ধর্মের একটি সদার্থক ব্যাখ্যা। মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী হবহাউজের মতে, মানুষের নীতিজ্ঞান ও ধর্ম চেতনাকে পৃথক করা যায় না। ধর্ম আসলে হলো আবেগমথিত নীতিচেতনা মাত্র ।
বিজ্ঞান বলতে পারে না নরহত্যা কেন খারাপ। কিন্তু ধর্ম বলে মানব জীবন হলো পবিত্র। তাই মানব হত্যা পাপ। বিজ্ঞান নীতিচেতনানিরপেক্ষ। আমরা আমাদের নীতিচেতনার জন্য ধর্মের ওপর নির্ভর করে থাকি। মানুষের জীবন কেবলই যুক্তিনির্ভর নয়। মানুষের জীবন পরিচালিত হতে চায় বিশ্বাসকে নির্ভর করে। তাই মানব জীবনে বিশ্বাসের আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ফরাসি নৃতাত্ত্বিক দুরকেইমের মতে, বিধাতা হলেন সমাজসত্তার দেবরূপমাত্র। আর ধর্ম হলো সমাজ জীবনকে ধারণ করে রাখার আধারমাত্র। ইংরেজি ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় আমরা দেখি, রিলিজিওন শব্দটা এসেছে রেলিগার শব্দ থেকে, যার একটি অর্থ হলো বন্ধন করা। অর্থাৎ রিলিজিওন হলো তাই, যা মানব জীবনকে চেয়েছে সুশৃঙ্খল করতে। বাংলা ভাষায় ধর্ম শব্দটার উদ্ভব হয়েছে ধৃ ধাতু থেকে, যারও অর্থ হলো ধারণ করে রাখা। মানুষ চেয়েছে ধর্মের মাধ্যমে তার সমাজ জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে; উন্নত মানব সম্বন্ধ স্থাপন করতে। ধর্ম কেবলই মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ঐতিহ্যবহ নয়। যদিও মুক্তচিন্তাবাদীরা সেটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছেন।
মৌলবাদ কথাটা আমরা এখন যথেষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মৌলবাদ বা ফান্ডামেন্টালিজমের উদ্ভব হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ প্রচারের পর। একদল প্রটেস্ট্যান খ্রিষ্টান করেন এই মতের বিরোধিতা। কেননা এই মত মেলে না বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে। তারা ছিলেন বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বের আক্ষরিক বর্ণনার পক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি অঙ্গরাজ্যে এখনো যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের অনুদান নিয়ে চলে, সেখানে ডারউইনের মতবাদকে সত্য বলে পড়ানো যায় না। ডারউইনের মতবাদের পাশাপাশি পড়াতে হয় সৃজনীবাদ। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা এখন আর মৌলবাদী নয়। কেননা পোপ  ১৯৪৮ সালে  ঘোষণা করেন যে, বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্বকে গ্রহণ করতে হবে রূপকভাবে, আক্ষরিক অর্থে নয়।
মুসলমান সমাজে মৌলবাদ কথাটা প্রচলিত ছিল না। প্রচলিত হয়েছে হাল আমলে। বলা হচ্ছে, মুসলিম মৌলবাদীরা নাকি হত্যা করেছেন অভিজিৎ রায়েকে। কেবল তাই বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে, এর পেছনে নাকি আছে জামায়াতে ইসলামী দল। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী দল কোনো মৌলবাদী দল নয়। এরা ইসলামের অর্থনীতিকে বাস্তবে চাচ্ছে প্রয়োগ করতে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, ধন কেবল ধনীদের মধ্যে সঞ্চালিত হতে দেয়া যাবে না। তাকে প্রয়োগ করতে হবে জনকল্যাণের কাজে (সূরা-৫৯: ৭)। তারা গ্রহণ করেছেন আধুনিক গণতন্ত্রের কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা। অন্তত বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর প্রচারপত্র পড়ে এই ধারণাই করতে হয়।
অভিজিতের মৃত্যু একটা করুণ ঘটনা। আমরা এ রকম মৃত্যুকে সমর্থন করি না। কিন্তু মনে করি, এর সাথে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করা যথাযথ নয়। এর আগে নিহত হয়েছিল বিশ্বজিৎ। তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করেছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছেলেরা। কিন্তু সে সময় কোনো প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকে এ জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করতে দেখিনি। কিন্তু এখন একদল বামপন্থী বুদ্ধিজীবীকে দেখছি দুঃখ প্রকাশ করতে। আর সেই সাথে দেখছি, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে অভিযুক্ত করতে। এটা কত দূর সঙ্গত হচ্ছে, আমরা তা বলতে পারি না।
এই সাথে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, এই সব বাম চিন্তক মনে করেন তারা যা ভাবেন তার বাইরে অন্য কিছু ভাবাটা হলো অবৈজ্ঞানিক এবং হলো অজ্ঞতা কুসংস্কারের পরিচায়ক। একদিন আমাদের দেশের বাম চিন্তকেরা বলতেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক। কিন্তু তাদের অনেকের সন্তান সন্ততি এখন যাচ্ছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং হচ্ছেন মার্কিন নাগরিক। এটাও আমাদের কাছে যথেষ্ট বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। অভিজিৎ মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। জানি না, কেন তিনি আবার এসেছিলেন বাংলাদেশে। শুনেছিলাম তার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, যা বিক্রি হচ্ছিল এবারের একুশের বইমেলায় বাংলা একাডেমি চত্বরে। তিনি এসেছিলেন বইমেলায় তার বই কেমন বিক্রি হচ্ছে সেটা নিজ চোখে দেখতে। কিন্তু তিনি খুন হলেন বইমেলা দেখে ফেরার পথে বইমেলার খুব কাছেই। যেখানে ছিল যথেষ্ট পুলিশ প্রহরা। তার বইতে তিনি কী লিখেছেন, আমরা তা পড়ে দেখিনি। তিনি নাকি ইসলামবিরোধী কথাবার্তা প্রচার করতে চেয়েছেন।
ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করা আর নিন্দা করা সমার্থক নয়। বাংলাদেশ একটি মুসলিমঅধ্যুষিত দেশ। এখানে ইসলাম নিন্দা মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলতেই পারে। বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী না হয়েও প্রগতিশীল ভাবধারার প্রচার সম্ভব। প্রগতিশীলতা আর ইসলাম নিন্দাকে একত্র করে ফেলা হবে ভুল। আমরা মানুষের মুক্তচিন্তার অধিকারে বিশ্বাস করি। কিন্তু নির্বিচারে  কোনো ধর্মের নিন্দা করাকে সমর্থন করি না।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.