কোন তালিকায় বাংলাদেশের নাম? by সাজেদুল হক

দীর্ঘ দুই মাস। উত্তেজনাকর ও শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতি। অবরোধ-হরতাল। পেট্রলবোমা-গুলি। প্রতিনিয়ত প্রাণহানি। কোথায় যেন আটকে আছে সব? কেউ জানে না পথের শেষ কোথায়? টানেলের শেষে কেউ সামান্য হলেও আলো দেখছেন, কেউ দেখছেন না। এ দৃশ্য নতুন নয়। জরুরি জমানা তখনও আসেনি। উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম একদিন টানেলের শেষে আলো দেখেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আলো আর আসেনি। দু’মাস ধরে বাংলাদেশ যা মোকাবিলা করছে তা একেবারে অভিনব নয়। শুক্রবার রাতেই টিভি টক শো’তে এক আলোচক বলে বসলেন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা বিচারকের বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। তবে পেট্রলবোমায় বিপুল মানুষের প্রাণহানি বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম। এ অভিশাপ আমাদের কত দিন তাড়িয়ে বেড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, যখন পৃথিবীর কোন না কোন জায়গায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ নিয়ে কথা হচ্ছে।

সর্বশেষ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইনের বক্তব্যটিই সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জায়গা সংকুচিত হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে তিনি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার এ উদ্বেগের পাশাপাশি আরেকটি বড় বিষয় পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সংকুচিত হওয়ার তালিকায় তিনি ১৬টি দেশের নাম উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ ছাড়া বাকি দেশগুলো হচ্ছে- আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বুরুন্ডি, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মিসর, হাঙ্গেরি, মিয়ানমার, ফিলিস্তিন ভূখণ্ড, রাশিয়া, সৌদি আরব, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, তুরস্ক,  ভেনেজুয়েলা ও ভিয়েতনাম। মানবাধিকার হাইকমিশনার আরও বলেন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অগ্নিসংযোগের ঘটনা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে অনেকে মারা গেছে। সুশীলসমাজ এবং বাকস্বাধীনতাও এখন আক্রমণের শিকার হচ্ছে। তারা কেবল উগ্রপন্থিদের দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে না; বরং সরকারি দমনমূলক আচরণেরও শিকার হচ্ছে। একই দিনে বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে বিবৃতি দেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হুগো সোয়ার। বিবৃতিতে তিনি বলেন, যুক্তরাজ্য সহিংসতা বন্ধ করতে, আস্থা গঠনের পদক্ষেপ নিতে, উত্তেজনা কমাতে এবং একটি সর্বজনীন ও সবার অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল, সরকার এবং সমাজের অন্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির কাছে চিঠি লিখেছেন, মার্কিন কংগ্রেসের ১১ জন সদস্য। চিঠিতে সঙ্কট থেকে উত্তোরণে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য কেরির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
কিছুদিন ধরে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিকের ব্রিফিংয়ে প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে বাংলাদেশের নাম। জাতিসংঘ মহাসচিবও কয়েক দফায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ নিয়ে। চিঠি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। সহিংসতা পরিহার আর সংলাপের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সঙ্কট সমাধানের। ১৬টি বন্ধপ্রতীম দেশের ঢাকার কূটনীতিকরাও উদ্যোগ নিয়েছেন দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এরই মধ্যে গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেছেন তারা। উল্লেখযোগ্য একটি দিক হচ্ছে, শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোই নয়, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নয়ন সহযোগীরাও শামিল হয়েছেন এ প্রচেষ্টায়। এর আগে ব্রাসেলস ভিত্তিক সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিল, খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তার বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। সংঘাতের ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশের তালিকায় ইয়েমেনের সঙ্গেই বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
একসময় বন্যা আর দারিদ্র্যের কারণে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শিরোনাম হতো বাংলাদেশ। গত দুই যুগে সে পরিচয় বহুলাংশে মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এসময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম মেজরিটি মডারেট গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে। নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও নজির তৈরি করি আমরা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর গ্রামীণ ব্যাংকও খ্যাতি নিয়ে আসে বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু গত কিছুদিনে সে পরিচয় ক্রমশ ম্লান হতে চলেছে। ইয়েমেন, কঙ্গোর মতো দেশের সঙ্গে আজ উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। ইকোনমিস্ট বলছে, বাংলাদেশে হয়তো শেষের খেলা শুরু হয়ে গেছে। এ খেলা এখন আমাদের কোথায় নিয়ে ফেলে তাই হবে দেখার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.