ম্যাডাম যেখানে স্যার by শিশির ভট্টাচার্য্য

আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে সম্ভবত এই রেওয়াজ নেই, কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীগুলোতে নারী কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার একটি প্রথা ইতিমধ্যে চালু হয়ে গেছে। এর প্রথম কারণ, স্ত্রীবাচক ‘ম্যাডাম’ শব্দটির তুলনায় পুরুষবাচক ‘স্যার’ শব্দটি বেশি সম্মানজনক এবং দ্বিতীয় কারণ ‘ম্যাডাম’ বলতে ‘কোনো না কোনো স্যারের স্ত্রী’ বোঝায়। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই ‘অধ্যাপক’ ও ‘শিক্ষক’। ‘অধ্যাপিকা’ ও ‘শিক্ষিকা’ স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ এবং স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ মাত্রেই পুংলিঙ্গ শব্দের তুলনায় কম সম্মানজনক। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে কাউকে ‘অধ্যাপিকা’ বললে তিনি রীতিমতো অপমানবোধ করেন!
‘মা’, ‘বোন’, ‘নানি’, ‘দেবী’ ইত্যাদি স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ যদি অসম্মানজনক না হয়, তবে ‘অধ্যাপিকা’ বা ‘লেখিকা’ কী দোষ করল? উত্তর: একজন অধ্যাপক, তিনি পুরুষ হোন, নারী হোন বা বৃহন্নলা হোন, তিনি একজন অধ্যাপক। পেশার নামের ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদ রাখার প্রয়োজন নেই। পাল্টা প্রশ্ন: ‘নেত্রী’, ‘অভিনেত্রী’, ‘নায়িকা’, ‘গায়িকা’ ইত্যাদি পেশাদ্যোতক শব্দ যদি আপত্তিকর মনে না হয়, তবে ‘অধ্যাপিকা’ কেন আপত্তিকর হবে?
সভা পরিচালনাকারী নারীকে ‘সভানেত্রী’ বলা যাবে না, কারণ এটি স্ত্রীবাচক শব্দ। নারী ও পুরুষ উভয়েই যদি পুংলিঙ্গ ‘অধ্যাপক’ হতে পারেন, তবে তাঁদের উভয়ের ‘সভাপতি’ হতে দোষ কোথায়? ‘সভাপতি’, ‘রাষ্ট্রপতি’, ‘শিল্পপতি’, ‘বিদ্যাপতি’ ইত্যাদি শব্দে ‘পতি’ অংশের অর্থ ‘স্বামী’ নয়, যার প্রমাণ লিঙ্গান্তরিত ‘রাষ্ট্রপত্নী’ বা ‘শিল্পপত্নী’’ শব্দ গ্রহণযোগ্য নয়। কে শোনে কার কথা! ‘সভাপ্রধান’, ‘শিল্পপ্রধান’ ইত্যাদি উভয়লিঙ্গ শব্দ একসময় চালু হয়ে যাবে। ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ শব্দ ব্যবহারের আগে অবশ্য ঠিক করতে হবে এর অর্থ ‘রাষ্ট্রপতি’ নাকি ‘প্রধানমন্ত্রী’ হবে।
শব্দ ব্যবহারে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে: ১. নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই পুংলিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে,
এবং ২. পুংলিঙ্গ শব্দ বাদ দিয়ে পুরুষ বা নারী কোনোটাই নয়—এমন কোনো অলিঙ্গিত বা উভয়লিঙ্গ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। বেমালুম বাদ পড়ে যাচ্ছে স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ। একদিন হয়তো ‘নারী’, ‘স্ত্রী’, ‘মা’, ‘বোন’ ইত্যাদি শব্দ আর ব্যবহারই করা যাবে না। মা ও বাবা দুজনেই হয়তো হবেন ‘বাবা’; ‘স্বামী’ আর ‘স্ত্রী’ শব্দের পরিবর্তে ইংরেজি Spouse-এর আদলে কোনো উভয়লিঙ্গ শব্দ উদ্ভাবিত হবে।
কিছু শব্দ বাদ দেওয়া হচ্ছে ব্যুৎপত্তির কারণে। ‘মহিলা’ শব্দটা নাকি অশ্লীল, কারণ এর উৎপত্তি ‘মহল’ থেকে। কিছু শব্দ যেমন ‘স্বামী’, ‘কর্তা’ বাদ দেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে পুরুষতন্ত্রের গন্ধ আছে বলে। ইংরেজি, ফরাসি বা অন্যান্য ভাষায়ও এ প্রবণতা লক্ষণীয়। ইংরেজিতে সর্বনাম শি (she)-এর পরিবর্তে দে (they) ব্যবহারের প্রস্তাব এসেছে। আপত্তি উঠেছে প্রেগন্যান্ট (Pregnant), হিস্ট্রি (History), হিউম্যান (Human), ম্যানমেইড (Manmade) ইত্যাদি শব্দ নিয়েও। ফরাসি ভাষায় ‘প্রেসিদ’ (President), ‘প্রোফেসর’ (Professeur), ডক্তর (Docteur) ইত্যাদি শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ ছিল না এসব পেশায় নারীরা ছিলেন না বলে। নারীবাদী লেখকেরা ফরাসি ব্যাকরণ অনুসারে শব্দগুলোর স্ত্রীলিঙ্গ রূপ গঠন করে প্রেসিদঁত’ (Presidente), প্রোফেসর (Professeure), ডক্তর (Docteure) লিখতেন। ইদানীং আবার ফ্রান্সে President, Professeur, Docteur চালু হয়েছে, যদিও কুইবেকের ফরাসিতে ‘প্রেসিদঁত’ (Presidente), ‘প্রোফেসর’ (Professeure), ‘দক্তোর (Docteure) এখনো বহাল আছে। একই ভাষায় দুই দেশের নারীবাদী লেখকদের শব্দ ব্যবহারে দুই রকম আচরণ ও অস্থিরতা এখানে লক্ষণীয়।
নারীবাদীরা মনে করেন, ভাষা লিঙ্গনিরপেক্ষ নয়। ভাষা সাধারণত পুরুষকে প্রাধান্য দেয় এবং নারীকে হেয় করে। নারীর সম্মান ক্ষুণ্ন হয় এমন অশ্লীল শব্দগুলো অবশ্যই পরিহার করতে হবে। ‘পতিতা’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘যৌনকর্মী’। কিন্তু নারী, পুরুষ, বৃহন্নলা সবাইকে একাধারে ‘যৌনকর্মী’ বলাটা প্রায়োগিক দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। কোনো মৌমাছি পুরুষ না স্ত্রী, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো মাথাব্যথা না থাকতে পারে, কিন্তু একজন কীটতত্ত্ববিদের কাছে মৌমাছির লিঙ্গ অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষার নিয়মগুলো পরিকল্পনামাফিক তৈরি ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর মতো সরল নয়, বহু লোকের অবচেতন অংশগ্রহণে এই নিয়মগুলো গ্রামের রাস্তার মতো জটিল, আঁকাবাঁকা। কোনো ভাষায় যদি লিঙ্গবৈষম্য থাকেও, সেই লিঙ্গবৈষম্য সেই ভাষাভাষী পুরুষেরা মিটিং করে সৃষ্টি করেনি। ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ সস্যুরের মতে, ভাষা দাবা খেলার মতো একটি সিস্টেম, যাতে সচেতনভাবে নতুন কোনো ঘুঁটি যোগ করা বা খেলার নতুন কোনো নিয়ম সংযোজন করা কার্যত অসম্ভব। কোনো ভাষার শব্দকোষে সচেতনভাবে কোনো লক্ষণীয় স্থায়ী পরিবর্তন সাধন করা গেছে, এমন উদাহরণ বিরল।
আরবি ভাষায় ‘শুর্তি’ মানে ‘পুরুষ পুলিশ’ আর ‘শুর্তিয়া’ মানে ‘মহিলা পুলিশ’। আরবি ভাষাকে লিঙ্গনিরপেক্ষ করতে হলে এ দুটি শব্দ বাদ দিয়ে কৃতঋণ পুংলিঙ্গ শব্দ ‘বুলিশ’ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফরাসি ভাষায় অ্যাঁ পোলিসিয়ে (Un policier) মানে ‘একজন পুরুষ পুলিশ’ আর উইন পোলিসিয়ের (Une policire) মানে ‘একজন মহিলা পুলিশ’। ‘পুলিশ’ শব্দটিকে লিঙ্গনিরপেক্ষ করার কোনো উপায় ফরাসি ভাষার ব্যাকরণ বা শব্দকোষে নেই। ব্যাকরণ বা শব্দকোষ যেখানে অনুমোদন করে না, সেখানে ভাষাকে লিঙ্গনিরপেক্ষ করার উপায় সাধারণত থাকে না।
ভাষার পরিবর্তন হলেই সমাজের পরিবর্তন হয় না। নাম বদলালে বস্তু পাল্টায় না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশ্যে ‘নিগ্রো’ শব্দ উচ্চারণ করা যায় না, কিন্তু তার মানে কি এই নয় যে সে দেশে বর্ণবাদের চিরসমাপ্তি ঘটেছে। ‘বেশ্যা’ শব্দটির ব্যবহার বন্ধ হলেই কি বাঙালি সমাজে ‘বেশ্যাবৃত্তি’ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে? শুধু নারীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়—এমন একটি অশ্লীল শব্দও যদি না থাকে বাংলা শব্দকোষে, তাহলেই কি বাঙালি সমাজে নারীর সম্মান বেড়ে যাবে? নারীকে ঈশ্বর হিসেবে পূজা করে—এমন সমাজেও সামান্য যৌতুকের কারণে গৃহবধূকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। যেসব আদিবাসী সমাজে সামাজিক লিঙ্গবৈষম্য নেই বলে ধারণা করা হয়। গবেষণা করে দেখা যেতে পারে, তাদের ভাষার শব্দকোষ ও ব্যাকরণে লিঙ্গবৈষম্য আছে কি না।
বাংলা ভাষায় নারীকে অপমান করার জন্য যেমন যথেষ্টসংখ্যক শব্দ রয়েছে, তেমনি পুরুষকে অপমান করার কাজে ব্যবহারযোগ্য মোক্ষম শব্দেরও কোনো ঘাটতি নেই। নারী বা পুরুষবাচক অশ্লীল শব্দ না থাকাও শব্দকোষের একটি দুর্বলতা। যখন গালি দেওয়ার প্রয়োজন হবে, তখন হাতের কাছে জুতসই শব্দ পেতে হবে। ‘মনের ভাব প্রকাশ’ আর ‘মনের ভার নিকাশ’—এই উভয় ক্ষেত্রেই ভাষার ভূমিকা রয়েছে।
সমাজের পরিবর্তন হলে একসময় ভাষার শব্দকোষে পরিবর্তন আসে। বেশির ভাগ বাংলাভাষীর শব্দকোষে ‘খাজাঞ্চি’ বা ‘কারকুন’ শব্দ দুটি নেই, কারণ বাঙালি সমাজে এই পেশা দুটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সমাজে নারীর অবস্থান এবং নারীর প্রতি পুরুষের মনোভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন হলে নারীবাচক অশ্লীল শব্দগুলো অব্যবহৃত হতে হতে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাবে। বাঙালি সমাজে লিঙ্গবৈষম্যের অবসান হলে বাংলা ভাষার লিঙ্গবৈষম্য নিজে থেকেই দূর হয়ে যাবে। সমাজের লিঙ্গবৈষম্য যদি রোগ হয়ে থাকে, ভাষার লিঙ্গবৈষম্য তার একটি উপসর্গ মাত্র। উপসর্গের উপশম হলেই রোগের উপশম হবে, এমনটা ভেবে নেওয়া ভুল হবে।
‘ম্যাডাম’ যখন ‘স্যার’ হয়ে যান, তখন সম্বোধনটাই শুধু পাল্টায়, প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ও অর্জিত বাকি সব স্ত্রীচিহ্ন, কণ্ঠস্বর, অলংকার, শৈলী, মানসিকতা সব অটুট থাকে। ‘ম্যাডাম’কে ‘স্যার’ সম্বোধন করাটা অনেকটা নারীর পুরুষের পোশাক পরার মতো। ময়ূরপুচ্ছ ধারণ না করে আপন কর্মবলে নারী হওয়াটাকেই কেন অহংকারের বিষয় করে তোলে না নারীরা? নারী কেন একদিন নিজেকে এমন অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে না, যেদিন ‘ম্যাডাম’ বা ‘অধ্যাপিকা’ বলে সম্বোধন করা হলে শাড়ি পরা পুরুষেরা গর্ববোধ করবে?
শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.