ডু অর ডাই নীতিতে বিএনপি by কাফি কামাল

টানা অবরোধ ও দফায় দফায় হরতালের মধ্য দিয়ে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের আন্দোলন। গতকাল ফের ৩৬ ঘণ্টার জন্য হরতালের সময়সীমা বাড়িয়েছে বিরোধী জোট। অবরোধ অব্যাহত রেখে দফায় দফায় হরতালের মধ্য দিয়ে চলমান আন্দোলন এগিয়ে নিতে চায় তারা। দলের শীর্ষ থেকে জেলা পর্যায়ের একাধিক নেতা এমন তথ্য জানিয়েছেন। নেতারা জানিয়েছেন, ঢাকার পাশাপাশি অন্তত ১০ জেলা মিলিয়ে গুচ্ছ হরতালের জন্য জেলা ২০ দলকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয়ভাবে দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে ২০ দল। এখন থেকে পাবলিক পরীক্ষা বা অন্য কোন কারণে কর্মসূচিতে ছাড় না দেয়ার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। যে কোন পরিস্থিতিতে একদফার আন্দোলন অব্যাহত রাখার পক্ষে অনড় বিরোধী জোট। জোটের শরিক দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে ২০ দল। ডু অর ডাই নীতিতে চলবে আন্দোলন। লাগাতার হরতালের পরবর্তী পর্যায়ে আসতে পারে অসহযোগ। তবে অসহযোগ ঘোষণায় তাড়াহুড়ো করবে না তারা। কেবল বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হলেই তাৎক্ষণিকভাবে সে পথে হাঁটবে। এদিকে বিজয় সন্নিকটে দাবি করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মহানগর বিএনপি, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব। পৃথক বিবৃতিতে তারা এ আহ্বান জানান। বিএনপি নেতারা প্রত্যাশা করেন, শিগগিরই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে। দেশের মানুষের মনোভাব, জনমতের চাপ, আন্তর্জাতিক মহলের ভূমিকা এবং নিরপেক্ষ শক্তির উদ্যোগে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। তেমন কিছু হলে ইতিবাচকভাবেই দেখবে ২০ দল। বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়াকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আন্দোলন থামানো যাবে না। সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলেও ২০ দলের কেন্দ্রীয় কিছু নেতা পরিস্থিতি অনুযায়ী করণীয় নির্ধারণ করবেন। সে অনুযায়ী একজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও আরেকজন মুখপাত্র ও সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। এজন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এখন কৌশলগত অবস্থানে রয়েছেন। এমনকি ঢাকা মহানগর বিএনপির সব মতের নেতারা আন্দোলনের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এখন থেকে তারা আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন। ইতিমধ্যে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস ও সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল যৌথভাবে নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি বিবৃতির মাধ্যমে সরব হয়েছেন। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, স্বল্পমেয়াদি কর্মসূচির মাধ্যমেই আন্দোলন সফল করার পরিকল্পনা ছিল ২০ দলের। তারা ধারণা করেছিলেন, সরকার প্রকাশ্যে যাই বলুক, শেষ পর্যন্ত জনগণের দাবি ও রাজনীতির বৃহত্তর স্বার্থে ইতিবাচক উদ্যোগ নেবে। তবে আন্দোলন শুরুর পর সরকারের ভূমিকায় তাদের সে ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এরপর দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের কৌশলও ঠিক করা হয়েছে বিরোধী জোটের তরফে। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সরাসরি যোগাযোগে নতুন করে চাঙ্গা হয়েছেন কর্মী-সমর্থকরা। তাদের সমর্থন এবং দাবির কারণে আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মনোবল পেয়েছেন খালেদা জিয়াও। তাই নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্যেও অনড় অবস্থানে রয়েছেন তিনি। টানা এক মাস কার্যালয়ে অবরুদ্ধ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা, ছেলের মৃত্যুর পরও নমনীয় হননি তিনি। ওদিকে সপ্তাহ দেড়েক মুক্ত রাখার পর শুক্রবার রাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, টেলিফোন, কেবল টিভি, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয় সরকার। পরের দিন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হলেও বাকিগুলো এখনও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সবকিছুর সংযোগ আবার দেয়া না হলে অবিরাম হরতালের হুমকি দিয়ে রেখেছে বিএনপি। দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এক বিবৃতিতে এমন হুমকি দেন। বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা দাবি করেন, বিএনপি কোনভাবেই নৈরাজ্যের পক্ষে নয়। এজন্যই সরকারকে পর্যাপ্ত সময় এবং দফায় দফায় সংলাপ-সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সরকার কর্ণপাত না করায় ২০ দলের সামনে আন্দোলনের কোন বিকল্প ছিল না। এদিকে ২০ দলের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে গাড়ি পোড়ানোসহ নানা নৈরাজ্য। এতে হতাহত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, বিএনপির ঘাড়ে নৈরাজ্যের দায় চাপানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এসব ঘটনায় প্রতিদিন মামলার পাহাড় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বিরোধী নেতাকর্মীদের ঘাড়ে। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হকুমের আসামি করে করা হয়েছে কয়েকটি মামলায়। বাদ যাচ্ছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের মতো বরেণ্য ব্যক্তিও। বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হচ্ছে ২০ দলের নেতাকর্মীদের। নেতারা জানান, নানামুখী অপপ্রচারের শিকার হলেও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে পিছু হটবে না ২০ দল। রাজনৈতিকভাবে ২০ দলের সামনে সে সুযোগ নেই। বরং আন্দোলনের গতি বাড়াতে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনা হবে। বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তীক্ষ্ন নজরধারীর মধ্যে কিছু যানবাহন চালানো হলেও দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল খুবই কম। বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, বিএনপি বড় রাজনৈতিক সংগঠন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত অনেকেরই পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। আন্দোলনের স্বার্থে তারা ব্যবসার ক্ষতি স্বীকার করছেন। তাদের মালিকানাধীন যানবাহনগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। কিন্তু তাদের ওপর মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের পাশাপাশি সরকারের তরফে নানামুখী চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকজনকে তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও চাপ প্রয়োগ করেছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন পরিবহন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও দিয়েছে সরকার।

No comments

Powered by Blogger.