‘বীরকে সম্মান না দিলে সেই দেশে বীরের জন্ম হয় না’ -মনোরঞ্জন ঘোষাল

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কণ্ঠযোদ্ধা মনোরঞ্জন ঘোষাল। কণ্ঠ দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি আগে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন। হারিয়েছেন অনেক আপনজনকে। তারপরও হাল ছাড়েননি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিয়মিত গান পরিবেশন করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশে ফিরছেন তিনি। এরপর থেকে নিয়মিত গান করে চলেছেন। বয়স কিংবা কোন কিছুই তার সংগীতের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারেনি আজ পর্যন্ত। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। যুদ্ধের সেই উত্তাল সময়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, যুদ্ধপরবর্তী সময় এবং বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফয়সাল রাব্বিকীন
কেমন আছেন?
দেশের যে অবস্থা, এই সময়ে তো ভাল থাকার কথা নয়। খুব অস্থির একটা সময় যাচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি অস্থিরতা কেটে যাবে ততই সবার জন্য মঙ্গল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে এমনটাই কি প্রত্যাশা ছিল?
বঙ্গবন্ধুর ডাকে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের স্বপ্ন সবার চোখে ছিল। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, ৩০ লাখ মানুষ যে দেশে প্রাণ দিয়েছে এবং ২ লাখ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছে, সে দেশেই পরবর্তীতে রাজাকাররা মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বেশ কিছু স্মরণীয় ও ট্র্যাজেডির ঘটনা রয়েছে আপনার। সে সম্পর্কে বলুন।
আমার জন্ম সাতক্ষীরার তালা উপজেলার গোনালী নলতা গ্রামে। বাবা যামিনীকান্ত ঘোষাল ছিলেন একজন লেখক ও বড়মাপের প্রকাশক। মা কমলা ঘোষাল ছিলেন গৃহিণী। আমার বড় ভাই রতন কুমার ঘোষাল এবং ছোট ভাই মদন মোহন ঘোষাল পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিক আক্রমণে শহীদ হন। নিরাপত্তার অভাব ছিল তখন। সে সময় শুনলাম সেন্টগ্রেগরি স্কুলে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন। আমিও গেলাম। যাওয়ার ৫ মিনিটের মাথায় হানাদার বাহিনী আমিসহ সেখানকার সব তরুণকে আটক করে এবং ধরে নিয়ে যায় জগন্নাথ কলেজে। সে সময় আমার হাত ও চোখ বাঁধা ছিল। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করলে সবাই মারা যান। অলৌকিকভাবে আমার গায়ে গুলি লাগেনি। সে সময় বৃষ্টি হচ্ছিল, তখন সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। জল, কাদা এবং রক্ত একাকার হয়ে মরার মতো পড়ে ছিলাম। আমি দাঁত দিয়ে হাতের দড়ি কেটে ফেলি। এরপর চোখের বাঁধন খুলে সেখান থেকে চলে আসি। তখন ভোর ৬টা। অনেক  সময় এবং কষ্টের পর মেঘালয়ের বাঘমারায় আসি। সেখান থেকে কলকাতার একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতায় শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছাই। ২২শে এপ্রিল বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে মুস্তাফা মনোয়ারের সঙ্গে দেখা হয়। তার দেয়া টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশের খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সঙ্গে আলাপ হয়। তার কথা মতো সুচিত্রা সেনের বাড়ির কাছেই ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দোতলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিসে আসি। ২৫শে মে থেকে সেখানে অনুষ্ঠান ও সংগীত প্রচার শুরু হলো।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দিনগুলো কেমন ছিল?
অসাধারণ। স্বাধীন হলেই আমরা দেশে ফিরবো। সেই আশা-স্বপ্ন নিয়েই দিনগুলো কেটেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান গেয়ে ৪০ রুপি পেতাম। আকাশবাণী কলকতায়ও গাইতাম ১০৫ রুপিতে। টিউশনি করতাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পেরেছি, এটাই বড় বিষয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে ফিরে কেমন লেগেছিল? গানে নিয়মিত হলেন কিভাবে?
স্বাধীনতার আগেই রেডিও-টিভিতে গাইতাম। স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে নতুন করে সব শুরু করলাম। আমার কাছে তখন থেকে তিনটি শব্দ খুব প্রিয়। ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘বাংলাদেশ’। কারণ, বঙ্গবন্ধু ডাক না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশ হতো না।
প্রায় ১০০০ গান গাওয়ার পাশাপাশি আপনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। কয়েকটি বইও লিখেছেন। দৈনিক মাতৃভূমি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছেন। এ পর্যায়ে এরকম ব্যস্ত থাকতে কেমন লাগে?
গান গাওয়ার পাশাপাশি পাঁচখানা বই রয়েছে আমার। এগুলো হলো, ‘শেষ পরিচয়’, ‘দেনা পাওনা’, ‘আশায় বাঁধে ঘর’, ‘প্রেম ও প্রয়োজন’ এবং ‘একান্ত আমি’। ‘সাপ্তাহিক ছুটি’ এবং ‘উইকলি হেরাল্ড’-এ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এখন দৈনিক মাতৃভূমির সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি। বিভিন্ন পত্রিকায় লিখি। টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিই। বিভিন্ন স্থানে অতিথি হিসেবে থাকি।
আপনি বেশ কিছু সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে কাজ করছেন। সে সম্পর্কে বলুন। স্বীকৃতি কি পেয়েছেন বলে মনে করেন?
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের চেয়ারম্যান, এশিয়ান কালচারাল সোসাইটির সভাপতি, বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সিটিজেন সোসাইটির মহাসচিব, ইন্টার রিলিজিয়ন হারমনি সোসাইটির মহাসচিব, বাংলাদেশ টেলিভিশন শিল্পী সংস্থার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত রয়েছি। ২০১১ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফি ইনস্টিটিউট থেকে আমাকে ‘ম্যান অব দি ইয়ার-২০১১’, ‘বাংলাদেশ স্বর্ণপদক’ ও ‘আমেরিকার অর্ডার অফ মেরিট’-এ ভূষিত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বলে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তবে ভারত সরকারের ইস্টার্ন কমান্ড ফোর্ট উইলিয়ামে ২০০৫ সালে লালগালিচা সংবর্ধনা প্রদান করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন রাজারবাগে আমাকে সংবর্ধনা দেয়। চলতি মাসের ২৩ তারিখ বিশুদ্ধানন্দ শান্তি স্বর্ণপদক দেয়া হবে আমাকে। কোন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাইনি বলে ক্ষোভ কিংবা দুঃখ নেই। তবে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা উড়লে বুকের ভেতর মোচড় দেয়। যারা মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল তারা দু’বছরের জ্যেষ্ঠতা পেয়েছে এবং সম্মানী কলার ব্যাজ পেয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের এক টাকাও সম্মানী বৃদ্ধি হয়নি। একই দেশে এটি একটি দ্বৈতনীতি।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে কি স্বপ্ন দেখেন?
যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি দেখে যেতে চাই। এছাড়া শাহবাগের বেতার ভবনে বঙ্গবন্ধুর কোন প্রতিকৃতি কিংবা স্মৃতিচিহ্ন নেই। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছিলেন। সে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, তার ভাষণ যদি বেতার ও টেলিভিশনে প্রচার না হয় তাহলে বাঙালি কর্মকর্তারা বেতার ও টেলিভিশনে যাবেন না। বেতারের বাঙালি কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণরত মূর্তি সেখানে রাখতেই হবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল এবং ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ও ভারতের তৎকালীন মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দিয়েছিলন। ইতিহাসের এই উজ্জ্বল ঘটনাগুলো আগামী প্রজন্মের জন্য স্মৃতিফলক হিসেবে থাকা উচিত। কারণ, আমি বিশ্বাস করি বীরকে সম্মান দিতে না পারলে সেই দেশে বীরের জন্ম হয় না।

No comments

Powered by Blogger.