সংবিধান ও রাজনীতি- খায়রুল হকের আশঙ্কা শতভাগ সত্য প্রমাণিত by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক

শিরোনামে স্থান বাঁচানোর জন্য যদিও ‘খায়রুল হক’ লেখা আছে, আসলে শোভনীয় প্রকাশ হচ্ছে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। আসলে মানুষের জীবনটা সংপ্তি হলেও যার যার নিজস্ব প্রোপটে বৈচিত্র্যময় হয়। জীবনের কোনো-না-কোনো অধ্যায় সর্বসময়ের জন্য উজ্জ্বল থেকে যায়। আবার কোনো-না-কোনো অধ্যায় স্মৃতিতে ম্লানও হয়ে যায়। হঠাৎ হঠাৎ কোনো-না-কোনো প্রোপটে সেই ম্লান স্মৃতি আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই, একটা মজার ব্যাপার বর্ণনা করে আজকের কলামটি শুরু করছি। আনুষ্ঠানিক স্মৃতির বর্ণনা আছে।
নয়া দিগন্ত পত্রিকা গায়েব
ঢাকা মহানগর থেকে প্রকাশিত অনেক উচ্চমানসম্পন্ন ও জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা আছে। এর মধ্যে তিনটি দৈনিক পত্রিকায় আমি কলাম লিখি। যথা : যুগান্তর, কালের কণ্ঠ ও নয়া দিগন্ত পত্রিকায়। গত বুধবার ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে এই  নয়া দিগন্ত পত্রিকার সাত নম্বর পৃষ্ঠায় আমার কলাম প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল, ‘সংলাপ এবং আন্দোলন’। মঙ্গলবার ২৭ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সন্ধ্যাবেলা এশিয়ান টিভিতে এবং রাত্রিবেলা মাই টিভিতে, লাইভ টকশোতে উপস্থিত ছিলাম একজন আলোচক হিসেবে। ওই দিনের আলোচনাগুলোতে অন্যতম বিষয় ছিলÑ বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা বা প্রোপট। যেহেতু টকশোতে সময় কম থাকে, সেহেতু সংপ্তি সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা ব্যাপকভাবে উপস্থাপন করা যায় না। তাই ওই দুইটি টকশোতে, আমি প্রকাশ্যে টিভি দর্শক-শ্রোতা মণ্ডলীর কাছে আহ্বান রেখেছিলাম যে, সংলাপ প্রসঙ্গে আমার যুক্তিগুলো ‘আগামীকাল বুধবার নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার লেখা কলামে পাবেন।’ বুধবার ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সন্ধ্যায় বাংলাভিশন নামে টেলিভিশন চ্যানেলে, ফ্রন্টলাইন নামের লাইভ টকশোতে উপস্থিত ছিলাম। সন্ধ্যাবেলার ওই টকশোতেও, একইরূপে বললাম, ‘আজকের নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমার লেখা কলাম পাবেন।’ বুধবার দিনের রাত ৮টায় মহাখালী এলাকায় গেলাম এক কপি নয়া দিগন্ত কেনার জন্য। একাধিক হকার বললেন, নেইÑ সব বিক্রি হয়ে গেছে। একজন হকার শুধু বললেন, সকালেই সব বিক্রি হয়ে গেছেÑ একজন মানুষ এসে এলাকার সব হকার থেকেই সব নয়া দিগন্ত কিনে নিয়ে গেছে। অর্থাৎ হয় আমার কোনো একজন শুভাকাক্সী অথবা আমার কোনো একজন অশুভাকাক্সী, সব পত্রিকা ইচ্ছাকৃতভাবে কিনে নিয়ে চলে গেছেন। ঠিক এই কলাম ও পত্রিকা প্রসঙ্গে আমার শুভাকাক্সী বা অশুভাকাক্সী বলতে আমি বুঝাব শান্তির প্রতি শুভাকাক্সী বা অশুভাকাক্সী। যেহেতু আমি মহাখালী এলাকায় থাকি, সেখান থেকে পত্রিকাকে গায়েব করে দেয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, ওই এলাকার কোনো আগ্রহী ব্যক্তি যেন আমার কলামটি পড়তে না পারেন। ঢাকা মহানগর বা অন্য কোনো মহানগরের কোনো এলাকায় এরূপ ঘটনা ঘটেছে কি না তার সন্ধান করার সুযোগ পাইনি। লণটি ভালো না; লণটি অশুভ। অর্থাৎ কারো কণ্ঠ রোধ করে দেয়া যেমন বাকস্বাধীনতার ওপর প্রত্য আগ্রাসন, তেমনই শুভ আহ্বান মানুষের কাছে পৌঁছাতে না দেয়া হচ্ছে পরো আক্রমণ, বাকস্বাধীনতার ওপর। যারা নয়া দিগন্ত পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক তারা তো অবশ্যই পড়ার সুযোগ পেলেন। যারা অনিয়মিত গ্রাহক বা যারা শুধু ওই বুধবারের দিনের জন্য গ্রাহক হতেন, তারা বঞ্চিত হলেন। তারপরও, যারা আগ্রহী তারা কষ্ট করে কলামটিকে খুঁজে বের করে পড়তে পারবেন। এখন ডিজিটাল যুগ, খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। খোঁজার জায়গা এই নয়া দিগন্ত পত্রিকার ওয়েবসাইট-এ, আর্কাইভস-এর ঘরে। ওয়েবসাইট নিম্নরূপ : www.dailynayadiganta.com অথবা আমার নিজের ওয়েবসাইটে গেলে সেখানেও ‘জেনারেল ইবরাহিমের নিজের লেখা কলাম’ শিরোনামের মধ্যে গেলেই পাওয়া যাবে। আমার ওয়েবসাইট নিম্নরূপ : www.generalibrahim.com অথবা, আমার নিজের ফেসবুকে প্রবেশ করলে, টাইমলাইনে ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখের স্ট্যাটাস দেখলে পাওয়া যাবে। ফেসবুকের ঠিকানা : general.smibrahim@yahoo.com
চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গ
৩ জানুয়ারি ২০১৫ সন্ধ্যায়, বেগম খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করা থেকেই বর্তমান চলমান আন্দোলন শুরু। বর্তমান মতাসীন সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করেন এবং ঢাকা মহানগরীকেও অবরুদ্ধ করেন। বাইরের কোনো জেলা বা শহর থেকে ঢাকা মহানগরীতে ২০ দলীয় তথা বিএনপির কর্মীরা যেন প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য ঢাকা অভিমুখী সকল প্রকার সড়ক যানবাহন ও নৌ-যানবাহন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সরকারি কৌশলে। রেলপথ আধাআধি বন্ধ করা হয়েছিল। ৫ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের সমাবেশ করা সম্ভব হয়নি। ৫ তারিখ বেলা পৌনে ৫টা-৫টার দিকে ২০ দলীয় জোটনেত্রী অবরুদ্ধ অবস্থায় তার গাড়িতে দাঁড়িয়ে অবরোধের ডাক দিয়ে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। বস্তুত সরকারি অবরোধকেই, ২০ দলের অবরোধে পরিণত করা হয়। আন্দোলনের মাঝখানে যুক্ত হয়েছে সহিংসতা। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা এই সহিংসতা করছেন। সরকারি দল বলছে, ২০ দলীয় জোট এ জন্য দায়ী। ২০ দলীয় জোট বলছে, সরকারের লোকেরা আংশিক দায়ী এবং অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা আংশিক দায়ী।
প্রোপট সহিংসতা
দেশব্যাপী, সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত মিডিয়া পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়ার ও জনমত গঠনের জন্য সরকারি চেষ্টা লণীয়। সরকারি লোকজন শোভন এবং অশোভন উভয় প্রকারের ভাষায়, বিরোধী শিবিরের সাথে আলোচনার প্রস্তাবকে বারবার প্রত্যাখ্যান করছেন। সরকারি লোকজন এবং সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা  এমনভাবে কথাবার্তা বলছেন যে, বাংলাদেশের একমাত্র সমস্যা বোধহয় এই সহিংসতা। সরকারি মহলের দাবি, আগে সহিংসতা বন্ধ করা হোক, তারপর অন্য কথা। অপরপে বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের বক্তব্য হচ্ছে, সরকার জনগণকে নিরাপত্তা দেবে, সরকার আইনানুগভাবে সহিংসতা বন্ধ করবে, আন্দোলন চলবে যতণ সরকার দাবি না মানছে। দাবি বলতে, সাত দফা প্রস্তাবনার ভিত্তিতে আলোচনা, যেন সর্বদলীয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যায়। ২০ দলীয় জোটের প থেকে অন্যতম যুক্তি, পুরো ২০১৪ সাল সরকার সময় পেয়েছে চিন্তাভাবনা করার এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করার কিন্তু সরকার কিছুই করেনি। আমিও মনে করি, বর্তমান সহিংসতা, সমস্যার উপসর্গ মাত্র অর্থাৎ পার্শ¦প্রতিক্রিয়া। আমার মতে এবং কোটি কোটি লোকের মতে, বর্তমান চলমান সমস্যাটি রাজনৈতিক সমস্যা।
রাজনৈতিক সমস্যার গোড়া
এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বিরাজমান সমস্যার গোড়ায় যাওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সমস্যার গোড়া বলতে অনেক সম্ভাব্য পয়েন্ট আছে। যথা: এক নম্বর, বিগত বিএনপি সরকারের আমলের শেষাংশে, প্রধান বিচারপতির অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানো। দুই নম্বর, ২৭-২৮ অক্টোবর ২০০৬ তারিখে রাজপথে লগি-বৈঠার আক্রমণ। তিন নম্বর। অনেক পদপে বাদ দিয়ে জনাব প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে, প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্বের অতিরিক্ত যুগপৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করা। চার নম্বর। মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক আপসের মাধ্যমে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং আওয়ামী লীগকে মতায় আনা। পাঁচ নম্বর, একটি ত্র“টিপূর্ণ প্রক্রিয়া অনুসরণের পর ২০১১ সালের ১০ মে তারিখে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক দেয়া সংপ্তি রায়ের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা। ছয় নম্বর, পঞ্চদশ সংশোধনীর সুবিধা নিয়ে গণভোট বিধান অবহেলা করা বা বাতিল করা। সাত নম্বর। পঞ্চদশ সংশোধনীর সুবিধা নিয়ে আওয়ামী মেজরিটি পার্লামেন্ট কর্তৃক গণভোটের বিধানকে অবহেলা ও অকার্যকর করা। আট নম্বর, পঞ্চদশ সংশোধনীর সুবিধা নিয়ে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে অতি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠন করা। নয় নম্বর, পূর্ণ একটি বছর (২০১৪ সাল) সময় পাওয়া সত্ত্বেও সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে আওয়ামী লীগ কর্তৃক কোনো আগ্রহী পদপে গ্রহণ না করা। সমস্যার গোড়া বলতে আমরা ৯টি উদাহরণ উপস্থাপন করেছি। আমরা মাত্র দুইটি নিয়ে এখন কথা বলব।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ
মেহেরবানি করে কয়েকটি তারিখ খেয়াল করুন। প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল অথবা বাতিল নয় প্রসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক সংপ্তি রায় প্রদানের তারিখ ১০ মে ২০১১। দ্বিতীয়ত, রায় প্রদানকারী মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হক চাকরি থেকে অবসরে চলে যাওয়ার তারিখ ১৮ মে ২০১১। তৃতীয়ত, সংপ্তি রায়ের  ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রদান করা হয়, তারিখ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১২। চতুর্থত, লিখিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি স্বার করার সময় তারিখ দিয়েছিলেন ১৬ মাস আগের দিন অর্থাৎ ব্যাক ডেইটে স্বার করা। পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের তারিখ ৩ জুলাই ২০১১ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ১৪ মাস আগে।
সুপ্রিম কোর্টের সংপ্তি রায়
এখন মেহেরবানি করে খেয়াল করুন যে, সংপ্তি রায় প্রদানের অল্পদিন পরই, তৎকালীন বাংলাদেশের পার্লামেন্ট পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে আনায়ন করে এবং পাস করে। পাস করার তারিখ ৩ জুলাই। ওই সময় মুখে মুখে, পত্রপত্রিকায় এবং পার্লামেন্টে হাজারবার বলা হয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করা হচ্ছে। অথচ সরকার দলীয়রা ছাড়া, বাংলাদেশের বাকি সবাই বলছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের সংপ্তি রায়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পে ছিল না। সংপ্তি আদেশে মোট তিনটি বড়-ছোট অনুচ্ছেদ ছিল। সংপ্তি রায় মতে একটি মাত্র বাধ্যতামূলক সংশোধনী সাপে,ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে, নিজেদের বিবেচনায় যথাযথভাবে সংশোধন করে আগামী দুইটি পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারবে। সংশোধন করবে পার্লামেন্ট। কিন্তু বাংলাদেশের তৎকালীন পার্লামেন্ট পুরো পদ্ধতিটি বাতিল করে দিলো।
মাননীয় খায়রুল হকের মনোভাব ও আশঙ্কা
আমার মতে, মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মূল নীতির পে ছিলেন। নিম্নের উদ্বৃতি পড়লেই বোঝা যাবে।  মাননীয় প্রধান বিচারপতি তার লিখিত রায়ের ১১৮৫ নম্বর অনুচ্ছেদে যেটা বলেন সেটা উদ্ধৃত করছি হুবহু। উদ্ধৃতি শুরু। ‘‘বিজ্ঞ এমিকাস কিউরিগণ সকলেই এই আদালতের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তাহাদের সুগভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা এবং দেশের প্রতি তাহাদের দায়িত্ব প্রশ্নাতীত। সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরিগণ কোনো-না-কোনো আকারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বজায় রাখিবার পে মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাহাদের আশঙ্কা নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হইতে পারে। তাহারা সকলেই দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তাহাদের আশঙ্কা আমরা একেবারে অবহেলা করিতে পারি না। যদিও তর্কিত সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ কে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হইয়াছে এবং ইহা অবশ্যই অবৈধ। তবুও এইরূপ আশঙ্কার কারণে সহস্র বছর পুরাতন ল্যাটিন ভাষার তিনটি নীতিবাক্য আমরা অনুসরণের জন্য গ্রহণ করছি। যথা: প্রথম নীতিবাক্যÑ প্রয়োজনে অবৈধ বিষয়বস্তুও বৈধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় নীতিবাক্যÑ জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন। তৃতীয় নীতিবাক্যÑ রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন।’ উদ্ধৃতি শেষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ এমিকাস কিউরি বলতে আটজনের মধ্যে সাতজন অথবা নয়জনের মধ্যে আটজন।
সংপ্তি রায়ে যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশের পার্লামেন্ট তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। প্রধান বিচারপতির আশঙ্কা শতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি আমলে নিয়েছিলেন তিনটি নীতিবাক্য, দেশবাসীকে জানিয়েছিলেন নীতিবাক্যের কথা এবং আশঙ্কার কথা। কিন্তু তৎকালীন পার্লামেন্ট সেটিকে আমলে নেয়নি। ফলে ২০১৩ সাল এবং ২০১৫ সালে যা হচ্ছে তা দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী দেখছেন। দেশে রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশে মারাত্মক অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চলছে। জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এখানেই শেষ নয়, একটি শুভঙ্করের ফাঁকির কথা বলি।
গণভোট প্রসঙ্গ
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, সমগ্র ভোটার সম্প্রদায়ের মতামত গ্রহণের জন্য বিশ্বব্যাপী তথা সর্বজন স্বীকৃত পদ্ধতির নাম: গণভোট বা রেফারেন্ডাম। বিশ্বের রাজনৈতিক প্রোপটে গণভোটের সর্বশেষ উদাহরণ হলো তিন মাস আগে যুক্তরাজ্যে। স্কটল্যান্ডবাসী স্বাধীনতা চায়, নাকি যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঙ্গরাজ্য হিসেবে যেমন ছিল তেমন থাকতে চায়, সেটা গণভোটে দেয়া হয়েছিল। গণভোটের ফলাফল : মেজরিটি বলেছেন, তারা স্বাধীনতা চান না। বাংলাদেশেও গণভোটের রেওয়াজ প্রথম থেকেই ছিল। গণভোট আইন ১৯৯১ (তারিখ ১০ আগস্ট ১৯৯১) এর দ্বারা এই রেওয়াজকে আরো শক্তিশালী এবং গঠনমূলক করা হয়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে বিএনপি ছিল সরকারি দল এবং আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল।
গণভোট আইন ১৯৯১-এর প্রয়োগ
১৯৯১ সালের গণভোট আইন দ্বারা বিধান করা হয়েছিল যে, সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৯, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২(ক) বা ১৪২ অনুচ্ছেদের সংশোধনের কোনো বিল বা আইন সংসদ পাস করার পরেও, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বারের আগে, প্রশ্নটি বা বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য গণভোটে দেয়া হবে। গণভোটের রায় ‘হ্যাঁ’ সূচক হলে, রাষ্ট্রপতি স্বার করবেন। গণভোটের রায় ‘না’ সূচক হলে, রাষ্ট্রপতি বিলটিতে স্বার করবেন না।
অনুগ্রহপূর্বক খেয়াল করুন যে, সংবিধানের ৫৮ নং অনুচ্ছেদের অংশ করেই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি প্রসঙ্গে এবং পদ্ধতিটি প্রবর্তন প্রসঙ্গে যে আইন পাস হয়েছিল, সেটি ছিল সরকারি দল বিএনপি এবং বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ সমগ্র দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সম্মতিতে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক মতৈক্যের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ ছিল এই আইনটি। গণভোট আইন-১৯৯১ মোতাবেক এই বিধান অর্থাৎ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮ পুরোপুরি বা অংশ, বাতিল করতে হলে, অবশ্যই গণভোট প্রয়োজন ছিল।
গণভোট ও জনগণের মতাহরণ
২০১১ সালের আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক কূটকৌশল প্রয়োগ করে। তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার অনুধাবন করে যে, বিষয়টি যদি গণভোটে দেয়া হয় তাহলে হ্যাঁসূচক উত্তর না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাহলে কিভাবে গণভোটে না দেয়া যায় আবার আইনও পাস করা যায়, তার একটা রাস্তা বের করা প্রয়োজন। এ জন্য পঞ্চদশ  সংশোধনীতেই তারা একটা বক্তব্য জুড়ে দেয় এই মর্মে যে, ৫৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে গণভোট লাগবে না। অর্থাৎ সংবিধানের ৫৮ নং অনুচ্ছেদের যে অংশ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি প্রসঙ্গে ছিল, সে অংশ বাতিল করা হয়, গণভোটে দেয়া ছাড়াই। কিন্তু মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সংপ্তি রায়ে গণভোটের বিধান বাতিল করার কোনো কথা ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ মেজরিটির পার্লামেন্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের বিধানও বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনগণের মতামত প্রয়োগের যে মতা সংবিধান জনগণকে দিয়েছিল, সেই মতা আওয়ামী পার্লামেন্ট বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌমত্ব ুণœ করে দেয়া হয়।
গণভোট প্রসঙ্গে সচেতনতা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিবাদী অংশের, সম্ভবত ৯৯ শতাংশ লোকই জানেন যে, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু একইসাথে যে গণভোটের বিধানও বাতিল করা হয়েছে এই সম্পর্কে ওই ৯৯  শতাংশ লোক সম্ভবত সচেতন নন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ২০১১ সালের মে-জুন-জুলাই মাসে, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অথবা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, প্রসঙ্গটি গণভোটে দেয়া হতো, তাহলে চূড়ান্ত ফয়সালা হয়ে যেত। জনগণের নামে, কেউই এখন ২০১৩-১৪-১৫ সালে, হ্যাঁ বা না, অর্থাৎ পে বা বিপে এই আন্দোলন করতে হতো না। এমনকি ২০১৫ সালেও বিষয়টি গণভোটে দেয়া যেত। গণভোটে দেয়া হলে যাদের জন্য আন্দোলন, যাদের নামে আন্দোলন বা যাদের নিরাপত্তার জন্য বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বা যেই জনগণের মঙ্গল কামনায় জনগণের ওপরই অত্যাচার চলছে, সেই জনগণই ফয়সালা করে দিতে পারতেন। ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন চলছে। সরকার কর্তৃক দমন-পীড়ন চলছে। আশা করি আন্দোলন সফল হবে। এতদসত্ত্বেও আমার বিবেক বলছে শান্তিপূর্ণভাবে বুদ্ধি ও বিচারভিত্তিক সমাধানের কোনো রাস্তা আছে কি না সেটা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুবিনুল হকসহ নেতৃত্বের পর্যায়ে যেসব  আইনজীবী আছেন, তারাও আমাকে এই বিষয়ে চিন্তা করতে এবং চিন্তা প্রকাশ করতে উৎসাহ দিয়েছেন ও সহযোগিতা করেছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট, অথবা বাংলাদেশের বর্তমান সম্মানিত আইনজীবী মহলের কোনো করণীয় আছে কি না এটি বিবেচনার জন্য বা এই প্রসঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসার জন্য আমি বিনীত প্রস্তাব রাখছি। মাননীয় শেখ হাসিনা ১ ফেব্র“য়ারি তারিখে বলেছেন, ২০ দল বিষধর সাপের মতো জাতিকে দংশন করছে। আসলে কে সংবিধানকে দংশন করে তবিত করেছে পাঠক সম্প্রদায় ও বাংলাদেশের জনগণ মেহেরবানি করে বিচার করবেন।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:), চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

No comments

Powered by Blogger.