পেট বাঁচাতে ওরা ঘুরে গ্রামে গ্রামে by ইমাদ উদ দীন

ওরা প্রতি বছরই শীত মওসুম এলে বেরিয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামে। এটাই তাদের নেশা আর একমাত্র পেশা। এ বছরও তাদের এমন বয়ে চলারীতির ব্যত্যয় ঘটেনি। কাঁধে বোঝা ও হাতিয়ার নিয়ে যথারীতি শীতল সকালে ওদের হাঁকডাক চলে তোষক বানানোর। তাদের এমন হাঁকডাক আর তাগিদে গ্রামের গৃহিণী হিসাব কষেন তোষক বানানোর প্রয়োজনীয়তা আছে কি না? গত ২৫শে জানুয়ারি মৌলভীবাজারের শমশেরনগর রোড এলাকায় ৫ জনের একটি দল ও রোববার কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে কথা হয় এমন ৪ জনের একটি দলের। দলনেতা গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার বাসিন্দা রবিউল।  ঠগবগে এ যুবকের সঙ্গে আলাপে জানা হলো এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আদ্যোপান্ত। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী এ চার তরুণ তাদের অভ্যস্ত চিরচেনা সেই গ্রামীণ রেওয়াজে বড় আওয়াজে একসঙ্গে হাঁকডাক দিয়েই জানান দিচ্ছেন, শীত এসেছে আমরাও এসেছি। শীতের ধকল থেকে বাঁচতে উম আর উষ্ণতায় থাকতে হলে আমাদের ডাকে সাড়া দিন। আর তৈরি করিয়ে নিন আপনার প্রয়োজনীয় শীত নিবারণের ব্যবহার্য কৃত্রিম উষ্ণতার উৎস রাজাই তোষক জাজিম, আর কত কি শিমুল কিংবা কার্পাস তুলা দিয়ে বানানো নানা ধরনের গরমের উৎস। ওরা জানালো মওসুমি এ ব্যবসা তাদের পেশা। এটা ছাড়া অন্য কাজ তাদের জানা নেই। তাই এই ২-৩ মাসের আয় দিয়েই চলতে হয় সারা বছর।  তাদের কাছে পুঁজি না থাকায় তারা শহরে এ ব্যবসা করতে পারেন না। শহরে দোকান হলে সারা বছর কমবেশি বিক্রি হয় তাতে সংসার চালানো যেত। কিন্তু কম পুঁজি থাকায় তারা শীত মওসুমে গ্রামে গ্রামে বেরিয়ে পড়ে। দেশের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে এ ব্যবসা ভাল হওয়ায় তারা প্রতি বছরই এখানে ছুটে আসে। তাদের এই হাঁকডাক শীত মওসুমে গ্রামবাংলার চিরচেনা শেকড়ের সংস্কৃতি। একই দিনে একই স্থানে দেখা মেলে কলিম নামের বেদেপল্লীর এক কিশোর, সে-ও হাঁকডাক দিচ্ছিল নিজস্ব ভঙ্গিমায়। তার ছোট কণ্ঠে বড় আওয়াজ, আপনার সোনা রূপার নেকলেস দুল, নোলক পানিত পড়লে থোকাই দিলাই। সারা গ্রামে বারবার একই আওয়াজ দিলেও তাতে মেলেনি তেমন সাড়া। কথা হয় তার সঙ্গে। তার পেশা ও জীবন-জীবিকার নানা দিক নিয়ে এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখন তো আর কেউ পুকুরে সোনা পরে গোসলে যায় না, এমনকি এ রকম বিত্তবানরাও এখন নিজবসত ঘরেই গোসল সারেন। তাই পুকুরে তো এখন আর আগের মতো সচরাচর এমন অঘটন বা দুর্ঘটনা ঘটে না। তাই এ পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করা যায় কি না? সে আমার সব কথার সঙ্গে একমত হয়ে বলল, ভাই দশ গ্রাম ঘুরেও একজন ভুক্তভোগী পাই না। কিন্তু তার পরও বাপ-দাদাদের সেই চেনা পেশা ছাড়ি কিভাবে? তাই পেট বাঁচাতে এখন এ পেশার সঙ্গে নানাজাতের মালা তাবিজ, কবজ, জড়ি, তাগা, কড়া এগুলো বিক্রি করেও স্বকীয়তা ধরে রেখেছি। কিশোর হলেও তার শেকড়ের সংস্কৃতির প্রতি অগাধ টান আর বিশ্বাস। এরই ফাঁকে গ্রামের  অনেক লোকজন এই স্থানে জড়ো হলো। হেঁসে হেঁসে ওরা জানাল, শীত এসেছে এখন দেখবা এরকম, গোয়াল ওয়ালা (গরুর হাতুড়ে বনাজি ডাক্তার) ঘি চমচম ও হজমি ওয়ালা। শাড়ি কাপড় ওয়ালা, মুড়ি ও লাডু ওয়ালা, হাওয়ায় মিঠাইওয়ালা, রাজাই ওয়ালা ও সোনা তুলাদের সরগরম হাঁকডাকে শীতে আসে উষ্ণতা। ওদের নানা ঢঙয়ের নানা স্বরের নানা প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য সেই পুরানো নিয়মে হাঁকডাক বেশ ভালই লাগে।

No comments

Powered by Blogger.