বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবল দিক বনাম দুর্বল দিক by রোবায়েত ফেরদৌস

জানি যে, রাজনীতির কোয়ালিটি বা গুণগত মানের দিক থেকে বাংলাদেশের স্কোর অনেক নিচে; কথা সত্য যে, ‘অনুন্নত রাজনীতি’ বাংলাদেশে রাষ্ট্রের উইক বা দুর্বল পয়েন্ট; সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্র দুর্নীতির ক্রমবিস্তার, আইনি-শাসনের নাজুক অবস্থা, বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা কিংবা বিচারহীনতার সংস্কৃতি- এগুলোও আমাদের দুর্বল দিক, তাও মানি। তবে গেল চার দশকে বাংলাদেশের ঝুলিতে গর্ব করার মতো যে অনেক অর্জন আছে সেটাও কিন্তু সমান সত্যি।
ক. প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি, খ. রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের শনৈঃ শনৈঃ বিকাশ, গ. ধান উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য, ঘ. প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক অর্থের অব্যাহত প্রবাহ, ঙ. তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে সাহসী পথ চলা, চ. এনজিও/ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজির চলমানতা, ছ. শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং জ. নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক পুঁজির বিস্ময়কর উত্থান এর অন্যতম; এগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্ট্রং বা সবল দিক। আমাদের শ্রম, আমাদের মেধা আর মেহনত করবার ক্ষমতা আমাদের সবল দিক; পুরো পৃথিবীতে আমাদের এই ক্ষমতার স্বীকৃতি আছে, প্রমাণ আছে।আমাদের সংস্কৃতি আমাদের সবল দিক, পহেলা বৈশাখ, রমনার বটমূল, গান-কবিতা আমাদের রাষ্ট্রের উজ্জ্বল দিক; কবিতা এ দেশে প্রায় সবাই লিখেন, মা-মাসি, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবার মাঝেই কাব্যলক্ষ্মী ভর করেন; যিনি লিখতে পারেন না, কবিতা রচনা করেন এমনকি তিনিও, মুখে মুখে, নাম হয় তার চারণকবি; এ যেন এক কবিতার দেশ। প্রতি বছর জাতীয় কবিতা উৎসব হয়, দেশের কয়েক হাজার কবি এতে অংশ নেন, নিজেদের কবিতা পড়ে শোনাবার জন্য গাঁটের টাকা খরচ করে ছুটে আসেন রূপসা থেকে, আসেন পাথুরিয়া, টেকনাফ, তেঁতুলিয়া থেকে। এই যে একুশের বইমেলা এটা অনেক ইতিবাচক নম্বর যোগ করেছে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে। সাইবেরিয়া থেকে ফি শীতে পরিযায়ী পাখি যেমন আসে, তেমনি অনেকে বার্লিন, সিডনি, নিউইয়র্ক কিংবা বিলেত থেকে ঠিক এই সময়ে পরিযায়ী পাখির মতোই বাংলাদেশে ছুটে আসেন কেবল বইমেলার টানে! কী অদ্ভুত সুন্দর এই প্রাণের টান, ভাবলেই কান্না পায়, ভূ-ভাগে আবেগঘন এমন দ্বিতীয় জাতি মেলা ভার। কাড়ি কাড়ি ডলার-পাউন্ড-ইউরো খরচ করে হাজার মাইল দূর থেকে প্রতি বছর প্রবাসী বাঙালিরা ছুটে আসেন বইমেলার ভিড়ে নিজেকে শামিল করতে, এই আতম্ভর আশায় যে, তারা যেন এই মিলনমেলা থেকে বাদ না যায়; দূরে থাকলেও তিনি-ও যে এই সংস্কৃতির একজন গর্বিত উত্তরাধিকার মেলায় এসে তার জানান দিতে চান। এভাবেই বইমেলা দেশি-প্রবাসী লাখো পাঠকের মনোজগতে শুভ অভিঘাতের সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অসম্ভব সবল দিক এটি। আবার এফডিসিকেন্দ্রিক বাংলা চলচ্চিত্র এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আমাদের দুর্বল দিক; যদিও কিছু ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে এবং পতন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে, শুভ দিক নিঃসন্দেহে সেটি। সংগীত আমাদের স্বাস্থ্যের দিক; আপনারা কী জানেন, বাংলাদেশেই বসছে পৃথিবীর বৃহত্তম ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী সংগীতের সবচেয়ে বড় আসর। পুরো তিন-চার রাত জেগে স্টেডিয়াম-ভর্তি সমঝদাররা উপভোগ করছে ধ্রুপদী সংগীতের মূর্ছনা, বলুন ভাবা যায়? এর চেয়ে বড় স্ট্রং পয়েন্ট আর কী হতে পারে? নিঃসন্দেহে ভাটিয়ালি, কবিয়াল, গম্ভীরা, জারি-সারি-লোককাহিনী আমাদের দারুণ স্ট্রং পয়েন্ট; পট, পুতুল নাচ, ঘুমপাড়ানি গান, ছড়া সেও সবল দিক বৈকি। বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গান আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের বিস্ময়কর সম্পদ- দেশকে নিয়ে এত সুরেলা, এত আবেগমেশানো গান পুরো পৃথিবীতেই বিরল। মুক্তিযুদ্ধের এত অসাধারণ সব গান আমাদের রয়েছে। ইতিবাচকভাবে বিস্ময়কর! আর রাজনীতি? সে আমাদের রুগ্ন দিক; শুধু রাজনীতির স্কোরটা একটু ভালো হলে আমাদের ঠেকিয়ে রাখার কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই। কাজেই দুষ্ট রাজনীতি আর নষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে দেশটাকে আমরা জিম্মি হতে দিতে পারি না। দোহাই মুক্তিযুদ্ধের, দোহাই শুভবুদ্ধির ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা’ আর ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার’ এহেন ন্যক্কারজনক খেলা থামান; যথেষ্ট হয়েছে- দয়া করে এবার আমাদের মুক্তি দিন, বাঁচতে দিন, স্কোরবোর্ডে চার-ছক্কা যোগ করতে দিন, আরও স্ট্রং আরও সবল রাষ্ট্র নির্মাণের পথ করে দিন; রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘হেথা হতে যাও পুরাতন’। জায়গা ছেড়ে দিন, পথ করে দিন যাতে নতুন সুজনশীল রাজনীতির বিকাশ এই বাংলায় সম্ভব হয়; পুরনো, বাতিল, ফসিলাইজড রাজনীতির দিন এখন শেষ; দরকার ঝলমলে, টাটকা, একুশ শতকের উপযোগী নতুন আর ক্রিয়েটিভ পলিটিক্স।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.