ম্যান্ডেলা ও পেট্রলবোমার রোডেশীয় অভিজ্ঞতা by মিজানুর রহমান খান

নাগরিক সমাজ থেকে শুরু করে সমাজের অনেকেই ‘কঠোর হাতে’ পেট্রলবোমা হামলার নাশকতা বন্ধে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন এবং সরকারও ‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ দেওয়ার মনোভাব ব্যক্ত করেছে। অন্যদিকে বিরোধী দলও তাদের সহিংস কর্মসূচিকে যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দাবি আদায়ে সহিংস পথ অবলম্বন এবং সহিংসভাবে তা দমনের লক্ষণ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিবদমান দুই পক্ষ গণতন্ত্রের ফয়সালায়—যে যেভাবেই দেখুক—হিংসাশ্রয়ী এমন পথ বেছে নিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। এ থেকে উত্তরণে বিদেশি অভিজ্ঞতা হয়তো সামান্যই সাহায্য করতে পারে, কিন্তু এর একটি বোধগম্য মূল্য অস্বীকার করা যাবে না।
শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের অধীনে রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বুাবয়ে) ১৯৬৫ সালে ব্রিটেন থেকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ওই সময় শ্বেতাঙ্গ সরকার ব্যাপকভিত্তিক পেট্রলবোমা হামলার মুখে পড়েছিল। আর এখন ২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেট্রলবোমার মতো নাশকতা বন্ধে নতুন আইন তৈরি এবং এ প্রসঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের বিধানসংবলিত ২০০৯ সালে প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী আইন কার্যকর করার কথা আলোচনায় আসে। পেট্রলবোমা হামলাকে রাজনৈতিক অপরাধ বিবেচনায় রোডেশিয়ার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার কী কী করেছিল, সেই গল্পে যাওয়ার আগে রাজনৈতিক দাবি আদায়ের কৌশল সম্পর্কে দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার মনের খবর জেনে নেওয়া যাক।
বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে তরুণ ম্যান্ডেলাও স্বাধিকারের দাবি আদায়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারণ, এএনসি ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ছয়টি ‘অন্যায্য আইন’ বাতিল; নইলে অসাংবিধানিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের কারাজীবনের শুরু হয়েছিল ১৯৬২ সালের আগস্টে। ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম বইয়ে লিখেছেন, ‘আমরা আলোচনা করলাম গান্ধীর অহিংস নীতি বা সত্যাগ্রহ (সংলাপে সমাধান) নীতি গ্রহণ করব কি না। কেউ বললেন, নীতি হিসেবে এটা অন্য যেকোনো পথের চেয়ে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ। অন্যরা বললেন, ‘নীতিগত কোনো জায়গা থেকে নয়, এটা কৌশল হিসেবে নেওয়া যায়। আমাদের উচিত হবে বিরাজমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কৌশল ঠিক করা। যদি আমরা কোনো একটি বিশেষ পদ্ধতি বা কৌশলে শত্রুকে পরাস্ত করতে পারি, তাহলে তা-ই করা উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র আমাদের চেয়ে ঢের শক্তিশালী। আমরা যদি সহিংসতার আশ্রয় নিই, তাহলে তারা তা ভয়ংকরভাবে ধূলিসাৎ করে দেবে।’
ম্যান্ডেলা অহিংস নীতির পূজারি ছিলেন না। তিনি জনসভায় পুলিশ দেখিয়ে জনগণকে খেপিয়ে তুলেছিলেন এই বলে যে ‘ওরা আমাদের শত্রু। অস্ত্র হাতে নাও এবং আক্রমণ করো।’ এমন উক্তির জন্য দলের তিরস্কার তিনি কবুল করেছিলেন। তবে তাঁর সরল স্বীকারোক্তি: রাষ্ট্র যেহেতু নির্যাতন চালাবে, সেই ভয়ে তাঁরা লক্ষ্মী ছেলে হয়ে ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘এটাই অহিংস নীতি গ্রহণের অনিবার্যতা হিসেবে দেখা দিল, কোনো বিকল্প হিসেবে নয়। এটাই ছিল আমার অভিমত। গান্ধীর মডেলের অহিংস আন্দোলনকে আমি অলঙ্ঘনীয় নীতি হিসেবে দেখিনি, পরিস্থিতির নিরিখে কৌশল হিসেবে দেখেছি। নীতি হিসেবে তা অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আত্মঘাতী হলেও কৌশল হিসেবে তা ব্যবহার করা উচিত, আর গান্ধী নিজেও তা বিশ্বাস করতেন।’ ম্যান্ডেলা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, ‘যদি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সহিংস পন্থায় দমন করা হয়, তাহলে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার যবনিকা ঘটে।’
দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্তবর্তী ঔপনিবেশিক রোডেশিয়া রাজনৈতিক অপরাধ ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করেছিল। সেখানে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্র বর্তমানে পেট্রলবোমাকে স্রেফ সন্ত্রাসী তৎপরতা হিসেবে দেখতে চাইছে। রাজনৈতিক সহিংসতা বিষয়ের গবেষক অধ্যাপক অ্যান্ড্রু নোভাক লিখেছেন, রোডেশিয়া যুদ্ধের গোড়ার বছরগুলোতে যখন আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল, তখন পেট্রলবোমা নিক্ষেপের দায়ে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছিল। বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড মানে হলো, বিচারকের পক্ষে এই অপরাধে অভিযুক্ত কাউকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে—জেল-জরিমানার সুযোগ নেই। আমাদের ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছরের কারাদণ্ড। ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অর্থ জরিমানা ও চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়ারও সুযোগ আছে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ রোডেশিয়া চরম আইন করেছিল। তবে তারা অন্তত ‘দেখামাত্র গুলি’ বা বন্দুকযুদ্ধের পথে যায়নি। কিছুটা সুযোগ রেখেছিল ন্যায়বিচারের।
১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত শ্বেতাঙ্গ উদারনৈতিক সাংসদেরা, কালো আফ্রিকান, এমনকি দক্ষিণ এশীয় সাংসদেরা ওই আইনের বিরোধিতা করেন। পেট্রলবোমা মারলেই বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের বিধান সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। কারণ রোডেশীয় সংবিধানে ‘নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড’ আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের মতোই নিষিদ্ধ ছিল। নোভাক লিখেছেন, ‘পেট্রলবোমা ছুড়লেই মৃত্যুদণ্ড, এমনকি কেউ তাতে ব্যক্তিগতভাবে আহত বা তার সম্পদের ক্ষতি না হলেও মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল। বিচার বিভাগের হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তাঁরা পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারীকে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে কোনো কম শাস্তি না দিতে পারেন।’ এই আইনটি কঠোর এবং তা অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ এর চেয়েও ভয়ংকর।
এ রকমের কঠোরতম দণ্ড কী প্রেক্ষাপটে রোডেশীয় পার্লামেন্ট গ্রহণ করেছিল, সেটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার। তখন ক্ষমতায় ছিল উইংসটন ফিল্ডের যুক্তফ্রন্ট সরকার। পেট্রলবোমা ছোড়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। আইনমন্ত্রী ক্লিফোর্ড ডুপন্ট সংসদে তথ্য দিয়েছিলেন, ১৯৬২ সালের শুরু থেকে ৭৩টি পেট্রলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছিল। এর মধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার ও তিনজনকে দণ্ড দেওয়া সম্ভব হয়। এতে নাগরিক আক্রান্ত হয় ৩৩টি ঘটনায়, বাকিগুলোয় ক্ষতি হয় সম্পদের। তাই তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিধান এনে সংসদে বলেন, ‘পেট্রলবোমা আজ খুব বেশি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে এবং দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিত করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে।’ আমরাও একই সমস্যায়। দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। তাই ডুপন্ট যা বলেছিলেন, আমাদের আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও হয়তো তা-ই বলবেন। ডুপন্ট পার্লামেন্টে বলেন, ‘পেট্রলবোমা নিক্ষেপ সর্বদাই পূর্বপরিকল্পিত এবং কখনো আত্মরক্ষার জন্য নয়।’ বিরোধী দল কেবল মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিধানের সমালোচনা করেছিল। তারা যুক্তি দিল: ‘আসল লোকেরা নেপথ্যে থেকে এ কাজে তরুণদের ব্যবহার করছে।’ সুতরাং কেন এই তরুণদের মৃত্যুদণ্ড হবে। গত শনিবার সন্দেহভাজন বোমা হামলাকারী হিসেবে ১০ বছরের মানিকের ওপর গণনির্যাতনের একটি আলোকচিত্র ঢাকা ট্রিবিউন-এ ছাপা হয়েছে।
রোডেশীয় প্রধানমন্ত্রী হোয়াইটহেড একটি মানবিক যুক্তি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আদালত কোনো ভুল করলে তা শোধরাতে নির্বাহী বিভাগ ক্ষমার অধিকার ব্যবহার করবে। সেখানে পেট্রলবোমার টার্গেট ছিল ইউরোপীয়রা। আর বাংলাদেশে নিরীহ মানুষ। শ্বেতাঙ্গ সরকার যদিও অস্বীকার করেছিল, এই আইনটি নির্দিষ্টভাবে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর প্রতিরোধী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু আমরা এটাও দেখব যে কঠোর আইন করে রোডেশিয়া সুফল পেয়েছিল। পেট্রলবোমা হামলা কমে গিয়েছিল। তবে যেটা লক্ষণীয় তা হলো, ৪২ দিনে ৫২ জন মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো বর্বরতা সেখানে ঘটেনি। ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডুপন্ট পার্লামেন্টকে অভিহিত করেন যে ১৯৬৩ সালে ১৮টি ও ১৯৬৪ সালের প্রথম দুই মাসে চারটি পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা ঘটে। কেউ মারা যায়নি। ২২টি হামলার মধ্যে ১৬টি বাড়িঘর লক্ষ্য করে ছোড়া হয়। এর ১৫টিতে মানুষের বসবাস ছিল। আর বাদবাকি একটি বাসে এবং অন্যগুলো খালি বাড়িতে নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৬৫ সালে দেখা যায়, নিরাপত্তা আইনের আওতায় ৭৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ৫১ জন দণ্ডিত হয়েছে, এর মধ্যে পেট্রলবোমার বিধানের আওতায় দণ্ডিত হয়েছিল ১৯ জন। দু-একটি চমকপ্রদ কাহিনিরও জন্ম নেয়।
তার একটি এমন: দিনটি ছিল ১৯৬৩ সালের ২ সেপ্টেম্বরের ভোরবেলা। শহরতলির হারারেতে একটি বাড়িতে ছোট্ট সলতে লাগানো একটি প্যারাফিনের বোতল নিক্ষেপ করা হয়েছিল এবং সেটি একটি শিশুর দোলনার ওপরে গিয়ে পড়ে। এই অপরাধে দুই ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মানিকের মতো এক কিশোরকে সাত বছরের জেল দেওয়া হয়। নোভাক লিখেছেন, ওঁরা কেউ পেট্রলবোমা নিক্ষেপকারী ছিলেন না। অথচ এই দণ্ড রোডেশীয় সুপ্রিম কোর্ট এবং পরে প্রিভি কাউন্সিলও বহাল রাখেন। কিন্তু রানইউওয়া নামের এক ব্যক্তির দণ্ড হয়। তাঁর অপরাধ, তিনি একটি বোতলের দরকার পড়ায় প্যারাফিন কিনেছিলেন। তবে তিনি ছিলেন জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের (জানু) সমর্থক। কে পেট্রলবোমা ছুড়েছিল, আদালতের রায়ে কোনো পর্যবেক্ষণ ছিল না। রিচার্ড মাপুলিসা দণ্ডিত হন; কারণ তাঁর নিক্ষিপ্ত পেট্রলবোমায় একটি কার্পেট পুড়ে সামান্য ছিদ্র হয়েছিল।
তবে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর আইন প্রবর্তন করে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ থামানো সম্ভব হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। ৯২টি পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা ১৯৬৭ সালে মাত্র দুটিতে এসে দাঁড়ায়। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে এক বছরের কম সময়ের ব্যবধানে রোডেশীয় পার্লামেন্ট ‘বাস্তবে প্রয়োগযোগ্য নয়’ বলে আইনটি বাতিল করেছিল। এ ধরনের কোনো আইন সেখানেও কাজে দেয়নি, বাংলাদেশেও দেবে না।
রাজনৈতিক সংকটকে আলোচনা করে আর অপরাধকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে প্রতিহত করুন। এখানে নতুন কোনো আইনের দরকার আছে বলে মনে হয় না। বিস্ফোরক আইনের কঠোর প্রয়োগই যথেষ্ট। বর্বরোচিত কোনো নাশকতাই রাষ্ট্রকে প্রতিশোধপরায়ণতার দিকে ঠেলতে পারে না। গ্রেপ্তার–বাণিজ্য, ক্রসফায়ার বা বন্ধুকযুদ্ধ আইনের পথ নয়, প্রতিশোধের পথ।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.