মানবতা কেঁদে ফেরে by নাহিদ তন্ময়

পেশায় ট্রাকচালকের সহযোগী বকুল দেবনাথ। দৈনিক আয় সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ আয়ের ওপরই নির্ভরশীল ছিল আট সদস্যের একটি পরিবার। যিনি একদিন কাজে যেতে না পারলে চুলায় আগুন জ্বলত না। পরিবারের সদস্যদের থালায় উঠত না এক মুঠো খাবার। ঘরে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। তার জন্যও চাই বাড়তি খাবার। চার শিশু আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের দু'মুঠো অন্ন জোগাতেই অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামেন বকুল। স্ত্রীর আপত্তি। বলেছিলেন, দ্রুতই ঘরে ফিরবেন। ঘরে ফেরা হয়নি তার। পেট্রোল বোমার আগুন ঝলসে দেয় তার শরীর। এরপর টানা পাঁচ দিন ভোগ করেন মৃত্যুযন্ত্রণা। অবশেষে হার মানেন। অনাগত সন্তান, প্রিয়তম স্ত্রী, শিশুসন্তান, অসুস্থ হয়ে বিছানায় থাকা বড় ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি। একজন অতি সাধারণ হতদরিদ্র বকুল দেবনাথ পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ায় কোনো ক্ষতি হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর। এত ঘটনার মাঝে এরই মধ্যে দেশের কেউই মনে রাখেননি একজন বকুল দেবনাথকে। কিন্তু স্বজনহারা পরিবারটি ভুলতে পেরেছে তাকে? দেশের কোনো মানুষ কি খোঁজ রাখছে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে কী চরম অমানবিক জীবনযাপন করছেন তার স্ত্রী-সন্তানরা? স্বজন হারানোর যন্ত্রণার পাশাপাশি এখন তারা নিত্যদিন ভোগ করছেন ক্ষুধার যন্ত্রণা। কতদিন তারা বয়ে বেড়াবেন এ যন্ত্রণা? এ প্রশ্নের সদুত্তর কি কারও জানা আছে?
শুধু বকুল দেবনাথের পরিবারই নয়, গত দেড় মাসে পেট্রোল বোমা ও ককটেল হামলায় আহত-নিহত সব পরিবারেরই এক দৃশ্য। পেটের দায়ে পথে নামা শ্রমজীবী মানুষ জীবিকার টানে রাস্তায় নেমে পুড়িয়েছে শরীর। যাদের উপার্জনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল এক একটি পরিবার। পেট্রোল বোমার আগুনে পুড়ে এরই মধ্যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অনন্ত ৫৩ জন। আহত হয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন আড়াই শতাধিক। রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার এসব পরিবার অমানবিক যন্ত্রণা নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছে। যাদের অনেকেরই এখন আর ঠিকমতো তিন বেলা উনুন জ্বলে না। অসহায় মা তার শিশু সন্তানদের মুখে দু'বেলা খাবার তুলে দিতে পারেন না। রাজধানীর মগবাজার এলাকায় বিভিন্ন বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করতেন স্বপ্না বেগম। স্বামী বাদশা মিয়া পেশায় রিকশাচালক। মধুবাগে তাদের সুখের সংসার। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রামের খালিশপুর থেকে ফেরার সময় গত ১৩ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোল বোমার আগুনে দগ্ধ হন তিনি। আগুনে তার মুখমণ্ডল, দুই হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে যায়। চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।
স্বপ্না জানান, আগুনে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার স্বামী বাদশা তার পাশেই পড়ে আছেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিন-রাত তার সেবা-যত্ন করে যাচ্ছেন। কিন্তু সুস্থ হয়ে আবার সেই পুরনো পেশায় ফিরে যেতে পারবেন কি-না এ নিয়ে চিন্তিত স্বপ্না বলেন, প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় করতাম। মূলত এ টাকা থেকেই দেওয়া হতো ঘর ভাড়া, চলত সংসারের খরচ। হাত দুটি আগের মতো কাজ না করলে পঙ্গুর মতো করেই জীবনযাপন করতে হবে। ওই জীবনে এভাবে স্বামীকে পাশে পাবেন কি-না এ নিয়েও শঙ্কা স্বপ্নার। আনুমানিক ২২ বছর বয়সী মিনারা। দুধে-আলতা রঙের সুন্দর মুখজুড়ে পোড়া ক্ষত। ১৩ জানুয়ারি পেট্রোল বোমার আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন মিনারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চাকরি বাদ দিয়ে স্বামী দিন-রাত পড়ে আছেন স্ত্রীর শয্যাপাশে। প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মিনারার ভয় তার পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে। আগের মতো সুস্থ জীবন-যাপন করতে পারবেন কি?

No comments

Powered by Blogger.