আবারো একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ by জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে জন্মগ্রহণ করেন।
কোকো ১২ বছর বয়সে বাবাকে হারান, তারপর মা খালেদা জিয়াই বাবার শূন্যতার দায়িত্ব মাথায় নিয়ে পরম স্নেহে, আদরে তাকে বড় করেন। জনগণ ব্যাপকভাবে কোকোকে জানতে পেরেছিল ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে মায়ের সাথে গ্রেফতার হওয়ার সময়।
এক-এগারোর সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে এবং ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেফতারের পর খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলের ওপর প্রচণ্ড চাপ ও ভয়ভীতি দেখাল তাদের সপরিবারে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য, নইলে তাদের জীবননাশ ও মামলা, নির্যাতন চলবে। তারেক রহমানের স্ত্রী ডা: জোবায়দা রহমানের সম্প্রতি ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে বেগম জিয়ার দেশপ্রেমের উদাহরণ পাওয়া যায়। ‘একজন মাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সন্তান, নাকি দেশ? উত্তরে তিনি বলেছিলেনÑ দেশ।’ আজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় জিয়ার অমর বাণী- ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ বড়।’
১-১১ সরকারের সময় ৭ মার্চ ২০০৭ তারেক রহমানের গ্রেফতার, সেপ্টেম্বর ২০০৭ খালেদা জিয়া ও কোকোকে গ্রেফতার। দুই ছেলের ওপর অমানুষিক নির্যাতন। মিথ্যা মামলায় জড়ানো এক সূত্রে গাঁথা। ১-১১ সময়ে খালেদা জিয়া বন্দী থাকা অবস্থায় মাকে হারান, প্যারোলে মাকে দেখেন। প্রায় দুই বছর আগে ছোট ভাই সাঈদ ইসকান্দার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৩ নভেম্বর ২০১০ শহীদ জিয়া পরিবারের ৩৮ বছরের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বেগম জিয়াকে উচ্ছেদ করা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ মতায় আসার পর থেকে কোনো মিথ্যা অপবাদ বাকি রাখলেন না সংসদে এবং এর বাইরে। খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও কোকোর বিরুদ্ধে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি চালিয়ে যাচ্ছেন। কোকো সেই হীন রাজনৈতিক শিকার।
কোকো রাজনৈতিক বা জাতীয় নেতা নন, সাধারণ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্রীড়া সংগঠক। ক্রিকেট ও ফুটবলের প্রতি ছিল আগ্রহ। ডিওএইচএস কাবের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য ও ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান। বাবার মতো তিনি সাদাসিধে জীবন যাপন করতে পছন্দ করতেন। তার ইন্তেকালে সারা দেশ শোকে মুহ্যমান হলো। জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, পাড়া-মহল্লায় এমনকি প্রবাসেও শত শত গায়েবানা নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। উপস্থিত ছিল হাজার হাজার মানুষ।
২৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হলো স্মরণকালের ঐতিহাসিক জানাজা। তার কফিনের এক সারি পেছন থেকে জানাজায় অংশ নিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। অবরোধ থাকা অবস্থায়ও কোকোর জানাজায় এত লোক উপস্থিত হওয়ার মূল কারণ, জনগণ জিয়া পরিবারকে নিঃস¦ার্থ ভালোবাসে এবং তার বিরুদ্ধে সাজানো মামলায় সাজা তারা মেনে নিতে পারেনি। ৫ জানুয়ারি ভোটারবিহীন সরকারের নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গুম এবং জিয়া পরিবারের ওপর জুলুম, গণতন্ত্র হত্যা এবং খালেদা জিয়াসহ ২০ দলের দাবি না মানার কারণে জানাজার জনসমুদ্রে চোখে ছিল পানি আর ক্রোধ।
আবার একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ। সরকার কোকোর লাশ কবরস্থ করার জন্য তার প্রাপ্য সামরিক কবরস্থানে দাফন করতে না দেয়া এবং পুত্র হারানোর দিনে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানুষ পোড়ানোর দায়ে হুকুমের আসামি, পরবর্তী সময়ে মামলার সংখ্যা বাড়ানো, ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান অফিসে বালুর ট্রাক, জলকামান দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা। ৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ওপর পেপার ¯েপ্র দিয়ে বর্বরোচিত হামলা, ছাত্রলীগ কর্তৃক তার অফিস জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি, সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎলাইন, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার হুমকি সরকারের দেউলিয়াপনার বহিঃপ্রকাশ।
সময় পেলেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের পত্রিকার লেখা পড়ি। তিনি ২৭ জানুয়ারি দৈনিক প্রতিদিনের সম্পাদকীয় খোলা কলামে লেখেন, ‘বেগম জিয়ার গেইট খোলা থাকলে কি এমন তি হত।’ কাদের ভাইয়ের ওই কলামের লেখায় দেখলাম, সস্ত্রীক তাকে ড. ওয়াজেদের মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে ঢুকতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। ড. আসিফ নজরুল প্রথম আলোতে ২৬ জানুয়ারি সময় চিত্র পাতায় উল্লেখ করেন, ‘শেখ হাসিনা নিজে ও তার স্তাবকরা নানা সময়ে জিয়া পরিবারের প্রতি অবমাননাকর নিষ্ঠুর অশুভ মন্তব্য করেছেন। তাঁর শাসনামলে খালেদা জিয়াকে অমানবিকভাবে তাঁর বাড়ী থেকে উৎখাত করা হয়েছে। নানাভাবে অপমানিত করা হয়েছে। ৩ জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি কার্যত বন্দি করে রেখেছে খালেদা জিয়াকে। মূলত তার সরকারের নিপীড়নের আশঙ্কায় দেশে ফিরতে পারেননি আরাফাত রহমান কোকো। বহু মানুষ হয়ত তাই মন্তব্য করেছেন যে, শেখ হাসিনা তাই রাজনৈতিক নাটক করার জন্য বা রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গেছেন।’ আসিফ নজরুলের লেখার সঠিকতা প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন পুত্রশোকে মুহ্যমান সপ্তাহ না কাটতেই ৩১ জানুয়ারি তার অফিসের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস সৃষ্টি করা হলো।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহফুজ উল্লাহ ২৭ তারিখ রাতে চ্যানেল আই সংবাদ পর্যালোচনায় বলেছেন, ‘কোকোর জানাজায় মানুষের উপস্থিতি বিরোধী দলের প্রতি জনগণের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তার যে বান্দাকে সম্মান দিয়ে নিয়ে যেতে চান, সেই সম্মানকে কারো পে রোখা সম্ভব নয়।’ ক্ষমতাসীন নেতৃবর্গ প্রায়ই বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। তাদের বক্তব্যের উত্তরে বলা যায়, অবরোধের দিন ২৭ জানুয়ারি শুধু ঢাকা শহরের তৃণমূল নেতাকর্মীসহ লাখ লাখ লোকের পায়ে হেঁটে বায়তুল মোকাররমে উপস্থিতি প্রমাণ করে তাদের জনপ্রিয়তা কোনপর্যায়ে। ৬৮ হাজার গ্রামে শহীদ জিয়ার উত্তরসূরি খালেদা জিয়া এবং লন্ডনে থাকা তারেক রহমান দু’জনই জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
সারা দেশে খালেদা জিয়ার ১৩টি জনসভায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে বিরোধী দলকে সরকার ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করতে দেয়নি। সরকারের ভয় ছিল সে দিন ১৫ থেকে ২০ লাখ লোকের সমাবেশ হলে সরকারের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে। বিরোধী দলের দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি না মেনে বিকল্প থাকবে না সরকারের। জনগণের ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে ভিন্নমত উপো করে ক্ষমতায় টিকে থাকাই যেন আওয়ামী লীগের মূল কাজ। গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার মূলত এখন বাক্সবন্দী। জনগণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা করতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক জয়যাত্রা।
mj_mintu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.