মাইশা, ক্ষমা কোরো না, অভিশাপ দাও by আনিসুল হক

এই ছবিটার দিকে তাকাতে পারি না। যতবার তাকাই, চোখ ফেটে জল আসে। আমি হাউমাউ করে কাঁদি। মাইশা আমার মেয়ে। মাইশা আমার ভাগনি। মাইশা আমার ভাতিজি। মাইশা আমার বোন।
মাইশা ক্লাস টেনের ছাত্রী। সে হয়তো আমাদের কিশোর আলো পড়ত। সে হয়তো গণিত অলিম্পিয়াডে যেত। সে হয়তো ভাষা প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিল, সবচেয়ে সুন্দর প্রশ্ন করে অতিথি অধ্যাপকের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছিল।
মাইশা তাসনিম যশোর পুলিশ লাইন স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্রী ছিল।
ছবিটির দিকে তাকান।
কক্সবাজারে কাজ ছিল তার বাবার। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েকে, স্ত্রীকে।
তারা এই ছবি তুলেছিল কক্সবাজারের ইনানী সৈকতে। পাথরের ওপরে বসে।
এই ছবি পোস্ট করেছিল মাইশা, ফেসবুকে।
আহা, মাইশা, তোমার এই জিনসের কাপড়ের হ্যাট, তোমার ওই বড় সানগ্লাসটার দিকে আমি তাকাই। কাচ দুটো কত বড়। ভেতরে তোমার নিষ্পাপ চোখ দুটি। যে চোখে কত স্বপ্ন।
তোমার হালকা নীল রঙের এই কার্ডিগানটা। তোমার নীল-বেগুনি প্রিন্টের জামাটা। এই সানগ্লাস কি তুমি কিনেছিলে কক্সবাজারের সৈকত থেকে? কত নিয়েছিল? দুই শ টাকা, তিন শ?
তোমার বাবার মুখের দিকেও আমি তাকাই। দেখে মনে হয়, ও তো পপলু ভাই নন, ও তো আমিই। ভাই বলছি বটে, কিন্তু তোমার বাবাকে আমি এর আগে দেখেছি কি না জানি না, কিন্তু ছোট দেশ, সবাই তো সবাইকে চিনি, হয়তো পপলু ভাইয়ের সঙ্গেও কোনো দিন কথা হয়ে থাকবে। তোমার বাবার চেহারাটাও এমন যে মনে হয়, এ তো আমিই, বা আমার কোনো বন্ধু, কিংবা ভাই।
তুমি রোজ রাতে ঘুমাতে তোমার মায়ের সঙ্গে। শুধু কক্সবাজার থেকে আইকন নামের বাসটিতে চড়ে আসার রাতে বসেছিলে বাবার পাশে। বাবার কোলেই ঘুমিয়েছিলে ওই ভয়ংকর রাতটিতে।
আগুন লেগেছে জেনে বাবা মাকে বললেন, তুমি নামো তাড়াতাড়ি, আমি মাইশাকে নিয়ে নামছি।
বাবার কোলে পুড়ে গেলে তুমি, মেয়েকে কোলে নিয়ে পুড়ে গেলেন বাবা। কে বাবা আর কে মেয়ে, ওই কয়লার স্তূপ থেকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না।
তোমার মা বেঁচে রইলেন দগ্ধ ক্ষত নিয়ে। বেঁচে রইল তোমার একমাত্র ভাই মাথিন। ঢাকার টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মাথিন বলছে, ‘মাইশা রোজ ঘুমাত মায়ের সঙ্গে, এখন তাকে বাবার পাশে শুইয়ে দিয়ে এলাম। এখন বাবা আর বোন ঘুমাবে পাশাপাশি। মা থাকবে একলা।’
আহা, তোমার মা কীভাবে থাকবেন একা? স্বামী আর মেয়েকে হারিয়ে?
মাইশা, তোমার বন্ধুরা কাঁদছে। মেধাবী ছাত্রী ছিলে তুমি, মাইশা। তোমার ভাইয়া পড়ছেন ইঞ্জিনিয়ারিং, তুমি পড়তে চেয়েছিলে ডাক্তারি।
তোমার পড়ার টেবিলটা সুন্দর করে সাজানো। পরিপাটি করে তৈরি করা আছে স্কুলব্যাগ। যশোরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডে তোমাদের বাসায়।
ওই টেবিলে আর তুমি বসবে না। ওই ব্যাগ আর তুমি পিঠে নেবে না। কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলে তুমি, সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষায় ভালো করতে চেয়েছিলে, আর তুমি যাবে না কোচিং সেন্টারে।
মাইশা, তুমি আমার মেয়ে। মাইশা তোমার এই ছবি দেখে আমি কতবার যে কেঁদেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
ও ক্ষমতালোভী নেতারা, আপনারা ক্ষমতা চান। ক্ষমতা নেন। নেন ক্ষমতা। রাখেন ধরে ক্ষমতা। শুধু আমাদের এই ফুটফুটে মেয়েটিকে আপনারা ফিরিয়ে দেন। কেন আপনারা ওকে মারবেন? কেন ওকে আপনারা মেরেছেন? ১৪ বছরের একটা কিশোরীর কী অপরাধ?
মানুষ মারা বন্ধ করেন। মানুষ মারা বন্ধ করেন। শিশুদের হত্যা করা বন্ধ করেন। নারীদের হত্যা করা বন্ধ করেন। মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ করেন। পোড়া শরীরের অসহ্য যাতনা দিয়ে বার্ন ইউনিটে মানুষ পাঠানো বন্ধ করেন।
আপনাদের ক্ষমতা লাগে, আপনারা ক্ষমতা নেন। আপনারা কামড়াকামড়ি করেন। আমাদের কেন মারেন? আমাদের শিশুদের কেন মারছেন? আমাদের নারীদের কেন মারছেন?
বাসভরা যাত্রী, ঘুমন্ত যাত্রী, ভেতরে নারীরা, ভেতরে শিশুরা, সেই বাসে যে পেট্রলবোমা মারে, সে মানুষ? যে নেতা তাকে এই অ্যাসাইনমেন্ট দেয়, সে মানুষ? যে নেতা এই কর্মসূচি দেয়, সে মানুষ? যে নেতা বলে সব স্বাভাবিক আছে, তার বিবেক আছে?
অবরোধ মানে কী? আগে অবরোধ কর্মসূচি তিন জোটও দিত, তা ছিল রেলপথ, রাজপথ, নৌপথ অবরোধ। নেতারা ম্যাপ এঁকে পয়েন্ট চিহ্নিত করে দিতেন, অমুক জায়গায় অমুক জায়গায় সমবেত হবেন। সেই জায়গায় গিয়ে জনতা বসে পড়ত। সেটাকে অবরোধ বলে। এখন কোথাও কেউ বেরোবে না। বাড়িতে বসে বসে খিচুড়ি খাবেন, আর মোবাইল ফোনে নির্দেশ দেবেন? অবরোধ মানে কি নেতারা জানেন? অবরোধকারী দলের এক নেতা বললেন, অবরোধে ঢাকার মধ্যে গাড়ি চলতে পারে। তাহলে ঢাকার বাসে কেন পেট্রলবোমা মারেন? ককটেল মারেন?
কেউ কারও কর্মসূচি পালনের জন্য একজন নাগরিককে বাধ্য করতে পারে না। আপনারা নিজেরা কষ্ট স্বীকার করেন। অনশন করেন। একজন নেতাও যদি একটা পোস্টারে নিজের দাবি লিখে রাস্তার ধারে দাঁড়াতেন, তা-ও তো বুঝতাম। একজনও যদি আমরণ অনশন করতে বসতেন, তা-ও তো বুঝতাম। নিজেরা কেউ কোনো কষ্ট করবেন না, জনগণকে কষ্ট দিয়ে দাবি আদায় হবে? মহাত্মা গান্ধী দিনের পর দিন অনশন করেছেন, হেঁটেছেন, কষ্ট করেছেন, জেল খেটেছেন, মার খেয়েছেন, নেতা হয়েছেন, তবু অহিংস থেকেছেন, থাকতে বলেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান দিনের পর দিন জেল খেটেছেন, দিনের পর দিন অনশন করেছেন, তার জন্য ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত ছিল, কিন্তু কোনো দিনও আক্রমণ করতে বলেননি। এমনকি ৭ মার্চের ভাষণেও বলেছেন, ‘আমাদের যেন বদনাম না হয়। এই বাংলার বাঙালি অবাঙালি সবাইকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের।’
আর আমরা এ কী আন্দোলন দেখছি? এ কী ধরনের পিশাচদের কবলে পড়েছি?
আমাদের নারীদের শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ কি বৈরুত হয়ে গেছে? ইরাক হয়ে গেছে?
আল্লাহর দোহাই লাগে, মানুষ মারা বন্ধ করেন। আপনাদের সন্তানের কসম, মানুষ মারা বন্ধ করেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি দেন। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করেন। রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান নেই। আর রাজনৈতিক কর্মসূচির বদলে নির্ভেজাল টেররিজম বা সন্ত্রাসবাদ—দাবি আদায়ের জন্য নিরীহ মানুষ হত্যা, মানুষের সমাবেশে বোমা হামলা—কোনো দিনও লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, নিকট ইতিহাসে দুনিয়ার কোথাও সন্ত্রাসবাদীরা সফল হয়নি।
মাইশা, তুমি আমাদের ক্ষমা কোরো না। তুমি আমাদের অভিশাপ দাও। তোমার মতো ১৪ বছরের নিষ্পাপ কিশোরীকে আমরা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছি। এবং সেই সময়ের সেই দেশের একজন লেখক আমি, তোমাদের জন্যও লিখি, কিছুই করতে পারিনি। কিছুই করতে পারিনি। তুমি আমাদের থুতু দাও।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.