বার্ন ইউনিটে মা-মেয়ের কান্না by আল-আমিন

মরিয়ম খাতুন রুপা। বয়স ছয়। চার বছর বয়সে হারায় পিতাকে। ছোট্ট শিশুটির দুই হাতে স্যালাইন লাগানো। অসহ্য যন্ত্রণায় সে থরথর করে কাতরাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মা, মা বলে শব্দ করছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। রুপার মাথা ধরে কাঁদছেন  তার মা নার্গিস বেগম। মা-মেয়ের কান্না আবেগাপ্লুত করে উপস্থিত সবাইকে।
এ দৃশ্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও সার্জারি ইউনিটের। পঞ্চম তলার শিশু ওয়ার্ডে ঢুকতেই হাতের ডানদিকের ১ নম্বর বেডে শুয়ে আছে শিশুটি। পেট্রলবোমার আগুনে রুপার গলা থেকে পা পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছে। শরীরে দগ্ধের পরিমাণ ৪৫ শতাংশ। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন তাকে উন্নত চিকিৎসা দেয়ার জন্য। বুধবার রাতে ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে নলজানী এলাকায় চলন্ত অবস্থায় একটি বাসকে লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছুড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই বাসটিতে আগুন ধরে যায়। এতে শিশু রুপাসহ ছয় যাত্রী দগ্ধ হন। রুপার সঙ্গে থাকা তার নানি শামিয়া বেগম সামান্য দগ্ধ হয়েছেন।
রুপার মা নার্গিস বেগম জানান, ২ বছর আগে তার স্বামী আবদুল মতিন গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কুশলপুরে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অর্থের অভাবে তার চিকিৎসা করা যায়নি। তখন রুপা চার বছরের শিশু। রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে আর নতুন করে ঘরসংসার করা হয়নি। পরে জীবন ও জীবিকার তাগিদে গ্রামের বাড়ি থেকে গাজীপুরের বৌরদা এলাকায় এক বান্ধবীর বাড়িতে চলে আসি। একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক হিসেবে চাকরিতে যোগ দিই। স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করি রুপাকে। তাকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। কিন্তু পেট্রলবোমায় এখন আমার সব শেষ হয়ে গেল।
তিনি আরও জানান, আমার মা শামিয়া বেগম গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাঝেমধ্যে তিনি গাজীপুরে আমার ভাড়া বাড়িতে আসেন। বুধবার ভোর বেলায় রান্না করে পোশাক কারখানায় চলে যাই। বিকাল ৫টায় অফিস ছুটি হয়ে যায়। কিন্তু, ওভারটাইম করছিলাম। ওইদিন সকালবেলায় আমার মা ও রুপা গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় এক আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যান। বেড়ানো শেষে একটি বাসে করে বাড়িতে ফিরছিলেন। তারা বাসের চালকের বামপাশে বসা ছিলেন। জানালার ধারে বসা ছিল আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন রুপা। বাসটি নলজানী এলাকায় আসামাত্র সন্ত্রাসীরা ওই বাসটিকে লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছোড়ে। পেট্রলবোমায় আগুন ধরে গেলে রুপার শরীর দগ্ধ হয়। আমার মায়ের বাম হাত সামান্য দগ্ধ হয়। পরে পথচারীরা তাদের গাজীপুরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পাঠান। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আমার মেয়ের শরীরের গলা থেকে পা পর্যন্ত দগ্ধ হয়েছে। তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। আমার আর্থিক অবস্থা খারাপ। কিভাবে তার চিকিৎসা করাবো। আমার মেয়ের কি অপরাধ? কেন তাকে দগ্ধ হতে হলো। বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল জানান, রুপার শরীরের ৪৫ ভাগ দগ্ধ হয়েছে। শিশু হওয়ায় রুপা দগ্ধ হওয়ার যন্ত্রণা সইতে পারছে না। তার শ্বাসনালি না পোড়ায় বেঁচে যাওয়ার আশা আছে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিয়ের আগেই দগ্ধ হলেন নাজমুল: হরতাল ও অবরোধে আহতদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ড ৫০৩ নম্বরে চিকিৎসাধীন ১৪ জন। অধিকাংশের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ওই ওয়ার্ডের ১০ নম্বর বেডে চিকিৎসাধানী যুবক নাজমুল। পেশায় পিকঅ্যাপ ভ্যানচালক। ২৬শে জানুয়ারি রাতে ঠাকুরগাঁও জেলার নয়াবাজার এলাকায় চলন্ত পিকঅ্যাপ ভ্যানে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এতে তিনি গুরুতর দগ্ধ হন। তার শরীরের ১৪ শতাংশ পুড়ে গেছে। গুরুতর আহত অবস্থায় পথচারীরা তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। তার মুখমণ্ডল ও শ্বাসনালি পুড়ে গেছে।
আহতের ছোট ভাই নান্নু জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানা এলাকায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল বড়। তার আয়ে আমাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ হয়। ভাইয়ের জন্য কনে দেখা হয়েছিল। আগামী মাসে তার বিয়ে হয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, দুর্বৃত্তরা তার পিকআপ ভ্যান লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা ছুড়লে তিনি আহত হন। বিয়ের আগেই তিনি দগ্ধ হলেন! নাজমুলের শরীরের অবস্থা জানতে চাইলে বিড়বিড় কণ্ঠে তিনি জানালেন, রাজনীতি বুঝি না। এই সহিংস অবস্থা চাই না। কর্ম করে শান্তিতে থাকতে চাই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের মুখ্যপাত্র অধ্যাপক ডা. খন্দকার সাজ্জাদ হোসেন জানান, অবরোধ ও হরতালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আহত হয়ে বর্তমানে বার্ন ইউনিটে ৬২ জন চিকিৎসাধীন। তাদের উন্নত চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা চলছে। আহতদের জন্য ইউনিটের দোতলায় ও পাঁচ তলায় বিশেষ ওয়ার্ড খোলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.