চাই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি by মো. শহীদুল আলম

১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার পরাধীনতা, যা ১০০ বছর ধরে নির্বিঘ্নে চলমান, শক্তিশালী এবং অনেকটা বাধাহীন। যার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, যা ব্রিটিশ বেনিয়াদের কাছে ছিল অবজ্ঞার। হোক অবজ্ঞা তবুও বিদ্রোহ, যা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রথম ধাক্কা হৃদকম্পন। দার্শনিক কার্ল মার্কস বলেছিলেন, সিপাহি বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এরপর সমাজ চলেছে, ভেতরে ভেতরে জমেছে বিদ্রোহ। হয়েছে আন্দোলন, হয়েছে দমন। উলেল্গখযোগ্য সূর্য সেন ও প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীদের দেশাত্মবোধ ও আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। এরপর এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তথাকথিত দেশ বিভাগ এবং মহান স্বাধীনতা। পাশাপাশি অযৌক্তিক জাতিভেদ, ধর্মভেদ ও জাতিগত সংঘাত সৃষ্টির অন্যায় সংস্কৃতির ব্যাপক চর্চা।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৭৫৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা, ইতিহাস, আন্দোলন ও আত্মাহুতির কোনোটিরই পুনঃ পুনঃ স্মরণ, পালন কিংবা প্রতিপালনের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। নেতৃত্ব ও গণমানুষ কেউই বড় ব্যর্থতা ও অর্জনকে স্মরণীয় কিংবা বরণীয় করে রাখার ক্ষেত্রে অবিরত কিংবা নিত্য প্রতিপালনীয় করতে পারেননি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের ত্যাগের মহিমা দ্যুতি ছড়িয়েছে প্রতিবছর, প্রতিমাস, প্রতিদিন। ত্যাগের মহিমা হিলেল্গাল তুলেছে প্রতিটি পরাধীন নর-নারীর হৃদয়ে ও অঙ্গে। পরাধীন বাংলার মানুষের স্মৃতির মিনার গড়ে উঠেছিল খুবই অল্প সময়ের মধ্যে, যা আগে কোনো আন্দোলনে দেখা যায়নি।
ঐতিহাসিক এ আন্দোলন ঘনীভূত হয়েছে ১৯৬৯ সালে ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত। শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থানকে দিয়েছে গুণগত পরিবর্তন। অতঃপর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু এবং বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৫২-এর অর্জনই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। আজ অবধি ভাষার জন্য লড়াই এবং সে লড়াইকে ঘিরে শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা, বইমেলা, বই ছাপানো, বই বিক্রি, কথামালা রচনা এবং বক্তৃতা আকারে প্রচার ও প্রকাশ চলেছে অবিরাম। অনেক আয়োজনের মধ্যেও বইমেলার অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে সৃষ্টিশীল এবং একুশ উদযাপনের সমন্বয়ক। শুধু তাই নয়, একুশকে ঘিরে সেই রচিত হয়েছিল যে গান, কবিতা ও নাটক আজও তা থামেনি। ভাষাশহীদ রফিক, শফিক, সালাম, বরকত ও জব্বার যেমন অমর, তেমনি মানুষের মন থেকে মুছে যায় না শিল্পী আলতাফ মাহমুদ, আবদুল লতিফ, স্থপতি হামিদুর রহমান, গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এবং নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর মতো বরেণ্য মানুষরা। আজ অবধি বাংলা ভাষার বিকাশে ও প্রকাশে খরস্রোত না এলেও এমনকি বাংলার উচ্চারণ প্রতিরূপ, শুদ্ধতা এবং সম্পূর্ণতা না পেলেও মহান একুশের যাত্রা থামেনি। খরস্রোতা নদীর মতো মহান একুশে বয়ে চলেছে আমাদের কথা, আমাদের গান, নাটক, নৃত্য ও কবিতা নিয়ে। শহীদ দিবস বয়ে চলেছে ফুলের শ্রদ্ধা, বিশেষ পোশাক, পাঞ্জাবি-চপ্পল এবং বঙ্গ নারীর লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে মিশে।
'একুশ মানে মাথা নত না করা
একুশ মানে_ হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিল করা।
একুশ মানেই শ্রদ্ধাঞ্জলি, পুষ্পে পুষ্পে মিনার ভরা।' যা সৃষ্টিশীল ও শোভন তাই সংস্কৃতি। আর যা অনুসরণীয় তাই শিক্ষা। সৃষ্টিশীল নয়, পালনীয় নয়, অনুসরণযোগ্য নয় এমন কোনো কিছুই সংস্কৃতি হতে পারে না। মহান ভাষা আন্দোলনের অর্জন অনবদ্য, অবিরাম, অজর-অমর-অক্ষয়। এর মধ্য দিয়ে সৃষ্ট, শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারা বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের একান্ত আপনার সংস্কৃতি। যার মধ্যে পরিস্ফুট দেশজ কালচারের সুসমন্বয় এবং অপরূপ ব্যঞ্জন্যময় সামগ্রিকতা বিশ্ববাসীর কাছে যা একাধারে ঈর্ষণীয় ও অন্যধারে শ্রদ্ধাস্পদ, সম্মানীয়, মোহনীয়।
একুশ আসে বসন্তে, ঝিরঝিরে হাওয়ায় ডানা মেলে। তাই প্রকৃতি সাজে বাসন্তীর সাজে। বদলে যায় রঙ-পাতা। শহীদ সালাম-বরকতের রক্তে লাল হয় ভোরের সূর্য। শহীদ রফিক-শফিকের রক্তেই যেন টকটকে লাল হয় বসন্তে ফোটা শিমুল-কৃষ্ণচূড়া। বরকতের রক্তে লাল হয়ে যায় ময়না, টিয়া, বৌ কথা কও সুরের হলুদ পাখির ঠেঁৗট। ১৮৫৮ সালের শহীদ মঙ্গলপাণ্ডে, অগি্নযুগের সূর্য সেন, প্রীতিলতা, প্রফুল্ল চাকী আর ক্ষুদিরামের রক্তের রঙ নিয়ে আজও ফোটে লাল গোলাপ, লাজ-রক্তিম অবগুণ্ঠিত বধূর কপালেও শোভা পায় লাল বৃত্ত। আবালবৃদ্ধ সবার মন হয় একাধারে সিক্ত, অন্যধারে রঙিন। লাখো শহীদের রক্তে লাল হয়ে আকাশে উড়ছে জাতীয় পতাকা।
সব অসত্য, অসৌজন্য, অপকর্ম, অসভ্যতা ও অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে মহান একুশের চেতনা সোচ্চার। অজ্ঞতা, অনাচার, অসুরবৃত্তি, দলন ইচ্ছা এবং সব অসুন্দর অস্তমিত হয়ে উদিত হোক সভ্যতার আবির রঙা সূর্য। ঘটুক আমাদের মোহ মুক্তি, বাড়ুক ন্যায্যতা। গড়ে উঠুক জাতিগত ঐক্য, যা আমাদের মনোজগতের উন্নতিকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির মোহনায় নিয়ে যাবে।
জেলা প্রশাসক, বরিশাল

No comments

Powered by Blogger.