বিনায়ক সেনের আহ্বানে সাড়া দিবে কি জামায়াত? by সাজেদুল হক

এ আহ্বান অভিনব নয়। তবে চমকপ্রদ। অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন। রাজনীতি-সাহিত্য আর সমাজ নিয়েও নানা সময়ে লিখেছেন। শনিবার এক আলোচনায় তিনি জামায়াতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধীদের পরিত্যাগ করার জন্য। সারা দুনিয়াতে এটা অবশ্য অনেকটা নিয়মই। কোন রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে দলীয় পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি। অন্তত তদন্তের সময় দায়িত্ব থেকে বিরত থাকেন। বাংলাদেশে অবশ্য এর বালাই নেই। এখানে রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন ‘আমি নিষ্পাপ’। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। যদিও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর ওই আন্দোলন অনেকটাই মিইয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ফখরুদ্দীন-মইনের জরুরি জমানায় সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। তবে জামায়াতের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতের অভ্যন্তরে একটি বিষয়ে ব্যাপক মতবিরোধ তৈরি হয়। ওই সময় প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের সুযোগ আসে জামায়াতের সামনে। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় জামায়াত থেকে দুই জন মন্ত্রী নিয়োগের অফার আসে। তবে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মন্ত্রিসভায় যোগদানের বিরুদ্ধে সে সময় দলের একটি অংশ সোচ্চার হয়। তারা দলের প্রধান দুই নেতার পরিবর্তে অন্যদের মন্ত্রিসভায় যোগদানের পক্ষে অবস্থান নেন। তাদের যুক্তি ছিল, দলের শীর্ষ দুই নেতা মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে দলীয় কার্যক্রম ব্যাহত হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। চারদলীয় জোট সরকারের পুরোটা সময়ই তারা মন্ত্রিসভায় ছিলেন। এ সময় অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। যদিও তাদেরকে মন্ত্রী করায় বিএনপিকেও এখনও সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, নিজামী-মুজাহিদের পরিবর্তে দলের তরুণদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার সুযোগ দিলে এ সমালোচনার সুযোগ থাকতো না। ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর অন্যান্য দল বিপাকে পড়লেও জামায়াতকে সে সময় তেমন কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে এক পর্যায়ে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই পটভূমিতে আওয়ামী লীগ দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার করে। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলটি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। আলোচনা রয়েছে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শেষ মুহূর্তে ওই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জামায়াত বিশেষ করে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতের অভ্যন্তরেও ব্যাপক আলোচনা হয়। এক পর্যায়ে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই গ্রেপ্তার হয়ে যান। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে গত বছর ডিসেম্বরে। দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে। শীর্ষ অন্য নেতারাও ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। দল হিসেবে জামায়াতকেও বিচারের মুখোমুখি করার আয়োজন চলছে। এ অবস্থায় নতুন নামে দল গঠন ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের বাদ দেয়া নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে জামায়াতের অভ্যন্তরে কখনও কখনও আলোচনা হয়েছে। তবে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আনুষ্ঠানিক কোন বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়নি। যদিও গত পাঁচ বছরে যারা জামায়াতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। তারা একসময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বয়সের কারণেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের কোন অভিযোগ নেই। তবে একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে সহসা জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বে কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন দলটির একজন তরুণ নেতা। তিনি বলেন, শীর্ষ নেতাদের রক্ষার জন্য জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা বিপুল আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন। কয়েক শ’ নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন, কারাভোগ করেছেন হাজার হাজার সমর্থক। নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে কয়েক শ’ নেতাকর্মীকে। এ অবস্থায় জামায়াতের শীর্ষ নেতারা দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে বিরাট আবেগের ব্যাপার। ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠনটির কর্মী-সমর্থকদের বিপুল চাপের কারণে চাইলেও জামায়াতের পক্ষে শিগগিরই শীর্ষ নেতাদের পরিত্যাগ করা সম্ভব হবে না। তবে তিন-চার বছরের মধ্যে যে নামেই হোক নতুন নেতৃত্বেই পরিচালিত হবে জামায়াত। অন্য কোন অভিযোগ থাকলেও ওই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.