আদালতে খালেদা জিয়ার ৩৫ মিনিট -দুই মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য ৭ই জানুয়ারি

দিনের শুরুটাই ছিল অন্যরকম। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিশেষ আদালতে হাজিরা দেবেন জানা গিয়েছিল আগেই। সকাল থেকেই পুরো আলিয়া মাদরাসা এলাকা কর্ডন করে ফেলে পুলিশ। পলাশী মোড়, বকশীবাজার আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় মোতায়েন করা হয় কয়েক শ’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। বন্ধ করে দেয়া হয় গাড়ি চলাচল। মোড়ে মোড়ে তল্লাশি। জড়ো হতে থাকে বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের কর্মীরা। সরকারের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিতে থাকে তারা। এরই মধ্যে রাষ্ট্র, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা প্রবেশ করতে থাকেন আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে। আইনজীবীদেরও আদালতে যেতে কাঠখড় পোহাতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরও বাধা দেয়। এরই মধ্যে সকাল ১১টা ১৮ মিনিটে এজলাসে প্রবেশ করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের নবনিযুক্ত বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। শুরুতে তিনি নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালের ২২শে  ফেব্রুয়ারি বিচার কর্মকমিশনে যোগ দেই। আমি মুন্সেফ হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। বিচারক হিসেবে বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেছি। সর্বশেষ আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিযুক্ত ছিলাম। আমাকে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থে আমাকে বদলি করা হয়েছে। আমি সততা ও ন্যায় বিচারে বিশ্বাসী। খালেদা জিয়ার পক্ষে এডভোকেট আমিনুল ইসলাম এ সময় দু’টি বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া এ আদালতে হাজিরা দেয়ার জন্য রওনা হয়েছেন। তিনি পথে রয়েছেন। তার না আসা পর্যন্ত শুনানি মুলতবি রাখা হোক। আর আইনজীবীরা আদালতে আসতে পারছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাধা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আদেশ দেয়ার জন্য তিনি আদালতের প্রতি আবেদন জানান। এ সময় বিচারক বলেন, এজলাস কক্ষের ধারণ ক্ষমতার একটি ব্যাপার রয়েছে। আর এখানে আগে বিশৃঙ্খলাও হয়েছে। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া তিন বার প্রধানমন্ত্রী ও দুই বার বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। তিনি আমাদের সবারই সুপরিচিত। আদালতের একটি সময় রয়েছে। ভবিষ্যতে এ আদালতের কার্যক্রম ঠিক সাড়ে ১০টায় শুরু হবে। তবে আজকের জন্য বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত আদালত মুলতবি করা হলো। ১১টা ২৪ মিনিটের দিকে বিচারক এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন। বেলা ১২টার ৩০ মিনিটের দিকে খালেদা জিয়া এজলাস কক্ষে প্রবেশ করেন। গোলাপি চাদর ও হালকা গোলাপি শাড়ি পরা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল। এ সময় তিনি সবাইকে সালাম দেন। তিন-চার মিনিট পর বিচারক এজলাসে প্রবেশ করেন। আদালত অনুমতি দিলে খালেদা জিয়া তার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে পড়েন। এ সময় সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আমাদের দু’টি আবেদন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এ আবেদনের শুনানি করবেন। শুরুতে খন্দকার মাহবুব হোসেন বিচারককে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, সকালে আপনি কিছু কথা বলেছেন। আমরাও আপনার কথা কিছুটা জানতে পেরেছি। আপনি বিভিন্ন পদে অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি আইন মন্ত্রণালয়ে ছিলেন। সাধারণত বিচার বিভাগের সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিদেরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়। ছাত্র জীবনেও আপনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। আপনি একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠনের বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। এ মামলাটি যার বিরুদ্ধে তিনি তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। এ মামলা বিচার করার জন্য আপনাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আপনি ভবিষ্যতে ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। আমাদের নামও হয়তো ইতিহাসে ছোট্ট করে হলেও লেখা থাকবে। এ মামলায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি আপনি আইন অনুযায়ী বিচার করবেন। বাইরে যে যা-ই বলুক না কেন, বিচার বিভাগ এখনও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়নি। এখনও মোটামুটি হলেও আইনের শাসন রয়েছে। আমরা কোন অবিচার চাই না, আমরা বিচার চাই। খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। তিনি তার বিচারিক জীবন সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর আমি সংসদ সচিবালয়ে কর্মরত ছিলাম। আশা করি সততা, সীমিত মেধা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিচারকাজ করতে পারবো। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। স্বচ্ছতা ও সততার সঙ্গে কোন আপস করবো না। এরপর খালেদা জিয়ার মামলা মুলতবি রাখার আবেদন জানান খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, এ মামলায় আমাদের আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করেছিল। ওই খারিজ আদেশ আমরা এখনও পাইনি। তার রিভিউ চেয়ে আবেদন দায়েরের সুযোগ রয়েছে। তবে এর বাইরে যে কথাটি বলছি, তা হলো আমাদের আজ প্রথম দেখা হলো। প্রথম দিনেই যদি ছুরি চালানো হয় তবে কেমন হবে? আমাদের আরও চেনা-জানা প্রয়োজন। সুপ্রিম কোর্ট এখন ছুটি চলছে। আমরা আইনজীবীদের মধ্যে যোগাযোগেরও ব্যাপার রয়েছে। এসব বিবেচনায় সময় মঞ্জুরের আবেদন জানাচ্ছি। তিনি আইনজীবীদের আদালতে প্রবেশে বাধা দূর করার জন্যও বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন রিভিউ দায়েরের যে যুক্তি উত্থাপন করেছেন, তাদের আবেদনে সে কথা বলা হয়নি। আবেদনে আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য সময় চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সাক্ষী দুদকের উপ-পরিচালক সাক্ষ্য দেয়ার জন্য উপস্থিত আছেন। তার অধীনে আরও অনেকগুলো মামলার তদন্ত রয়েছে। বারবার তার সাক্ষ্য দিতে না পারার কারণে দুদকের কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে আইনজীবীদের প্রস্তুতির কারণে সময় দেয়া না দেয়ার বিষয়টি বিচারকের নিজস্ব এখতিয়ার। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা কোন দয়া চাইছি না, আমরা সহানুভূতি চাই। শুনানি শেষে বিচারক জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার কার্যক্রম ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেন। দুপুর ১টা ৫ মিনিটের দিকে আদেশ দেয় আদালত। শুনানিকালে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন, জিয়াউর রহমান খান, নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম, জাকির হোসেন ভূঁইয়া প্রমুখ। বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস, আব্দুল্লাহ আল নোমান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আব্দুস সালাম, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু প্রমুখ। আদেশের পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এই মামলায় নতুন বিচারক বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। আমরা তার কাছে ন্যায়বিচার চেয়েছি। উনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আজকে মামলার  কার্যক্রম চালানোর মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। এ জন্য মামলার কার্যক্রম মুলতবির আবেদন করি। বিচারক আমাদের আবেদন মঞ্জুর করে আগামী ৭ই জানুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন। তিনি বলেন, নতুন বিচারকের কাছে আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। এতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে বলে আমরা আশা করি। নিরাপত্তার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ির সমালোচনা করে তিনি বলেন, নিরাপত্তার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের আইনজীবীদের অনেককেই আদালতে ঢুকতে দেয়নি। পথে পথে বাধা দিয়েছে। আমাদের অনেকের গাড়ি আটকে দিয়েছে। আমাদেরকে হেঁটে আসতে হয়েছে। এ বিষয়টিও আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি। আদালত বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন। দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল  সাংবাদিকদের বলেন, আজকে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। আমরা সাক্ষীও হাজির করেছিলাম। কিন্তু আসামি পক্ষের আইনজীবীদের কোন প্রস্তুতি ছিল না বলে তারা আদালতে আবেদন করেন। আমাদের আপত্তি  সত্ত্বেও আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।  তিনি বলেন, এই মামলার অন্যতম আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে বিদেশে অবস্থান করছেন। তার বিষয়ে আদালতকে আমরা অবহিত করেছি। যদি মামলার পরবর্তী তারিখে তিনি হাজির না হন তাহলে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.