পাঠ্যবইয়ে বন্দি ‘নীতি’ by আলী ইদরিস

‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’ কবি শিশুর ভেতরে শিশুর পিতা শুধু ‘প্রজনন’ অর্থে ব্যবহার করেননি। আজকের শিশু কাল কিশোর, পরশু যুবক হবে। তখন সে শিক্ষক, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সারা পৃথিবী থেকে অনেক কিছু শিখবে। তার সেই লব্ধ জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করে দেশকে এগিয়ে নেবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো- ‘সদা, সত্য কথা বলিবে, সততাই সবচে’ উৎকৃষ্ট নীতি, গুরুজনকে মান্য করিবে, ইত্যাদি।’ পাঠ্যবইয়ে এসব নীতি কথা এখন বন্দি। শিক্ষকগণ এখন শ্রেণীকক্ষে পড়ান না, শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে আসতে বাধ্য করে ব্যবসা করেন। শিশুর মনে তখন থেকেই বিরূপ ধারণা অঙ্কুরিত হয়। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার শিশু-কিশোরকে শাসন করলেও উচ্চবিত্ত, ধনাঢ্য ও রাজনৈতিক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েকে শাসন ও সুশিক্ষা দেয়ার সময়, সুযোগ পান না, ফলে অনেক কিশোর-যুবক বিপথগামী হয়। এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বয়স্ক শিক্ষার্থীরা, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতির প্রতি উৎসুক হয়। প্রথমেই দেখে ঘুণেধরা সমাজে সততা নেই, আছে সন্ত্রাস, অর্থলোভ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার। সমাজের অনেক পেশাজীবী, সরকারি, বেসরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, এমনকি কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষাদানে কর্মস্থলে আত্মনিয়োগ না করে বাইরে অর্থ কামাচ্ছেন, ব্যক্তিস্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরে আনুগত্য দেখাচ্ছেন। এসব শিক্ষকের আদর্শই তো শিক্ষার্থীরা অনসুরণ করবে। এরপর আছে রাষ্ট্র। প্রজন্মসহ দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর অভিভাবক, নিয়ন্ত্রক, নিরাপত্তা প্রদায়ক প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। জনগণ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, রাষ্ট্র জীবনযাপনে, চলাফেরায়, যাতায়াতে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। কিন্তু রাষ্ট্রই যদি জনগণের অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শান্তিতে ঘুমোবার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে না পারে, তাহলে এ ব্যর্থতা শুধু রাষ্ট্রের নয়, রাজনীতিবিদগণেরও। কারণ সংসদ সদস্যবৃন্দই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হন। তিনশ’ নির্বাচিত প্রতিনিধির সবার দায়িত্ব সমান, শুধু মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর ওপর দায়িত্বভার ছেড়ে দিলেই কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু আমাদের সংসদে সংসদ সদস্যবৃন্দ নিজ এলাকা, নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দুর্নীতিদমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা  এসব বিষয়ে কথা বলেন কম-বেশি সময় ব্যয় করেন বিরোধী দলের সমালোচনায়। এদিকে নির্বাচিত প্রতিনিধি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত  হওয়ার কথা। কিন্তু ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন তথা সরকারের ভূমিকা ও ঘটনাবলি থেকে প্রজন্মের সুশিক্ষা নেয়ার মতো উপাদান নেই। শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা শিখেছে, একদলীয় নির্বাচনের  সঙ্গে তার মিল নেই। দু’টি বৃহৎ দলের মধ্যে আলোচনা সংলাপ তো স্বপ্নাতীত ব্যাপার। একদলের নেতা নেতৃগণ অপর দলের নাম শুনলেই শরীরে এলার্জি হয়, গালাগালি, কাদা ছোড়াছুড়ি তো আছেই। আরও রয়েছে কথা না রাখার প্রতিযোগিতা, ছলে বলে, গায়ের জোরে, রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়োগ করে বিরোধীদলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন, সন্ত্রাসীদের লালন পালন ইত্যাদি। রাজনীতিতে ন্যায়নীতি দেশপ্রেম, সততা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই, একজন নুর হোসেন ও ডা. মিলন নিজের বুকের রক্ত দিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের একনায়কতন্ত্রের দুর্গ থেকে গণতন্ত্র ছিনিয়ে এনেছিলেন। তখন দু’টি বৃহৎ দলের নেতৃদ্বয় কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এরশাদের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন রাজপথে সংগ্রাম করেছিলেন। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সেই গণতন্ত্রকে এ দু’নেত্রীই যথাযথ মর্যাদা দেননি। একনেত্রী ফেব্রুয়ারি ও মাগুরার নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করেছিলেন, অপর  নেত্রী ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে আধামরা লাশে পরিণত করেছেন। রাজনীতিবিদ তথা রাষ্ট্রনায়কদের ওইসব কর্মকা- থেকে প্রজন্ম কি শিক্ষা নেবে? যে স্বৈরাচারী নুর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করেছিল সেই স্বৈরশাসক এখন ভোটবিহীন নির্বাচনে এমপি এবং ‘গণতন্ত্রের পূজারি’ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। এখন অন্য এক নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জের  সাত খুনের আসামি হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধির আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে আছেন। আজ রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বাহিনীর সদস্যগণ সাত খুনের আসামি। যে সরকারের আমলেই হোক প্রশাসনের চাকুরেরা যদি খুনের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত হন, তাহলে  সুশাসন কায়েম করা স্বপ্নাতীত ব্যাপার। অন্য একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে রয়েছে ১০ জন বিহারিকে তালাবদ্ধ করে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ। বিহারিরা অসহায়, তাই মামলা করতে ভয় পাচ্ছে, উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অর্থের লোভে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ক্ষমতার বাণিজ্য, খুনোখুনিতে লিপ্ত। সমস্ত অপরাধের  নেপথ্যে অবৈধ অর্থ, প্রতিপত্তি, আধিপত্য ও ক্ষমতার লোভ কাজ করছে এবং অপরাধীরা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে। রাষ্ট্র্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে রাজনীতি তাই এখন মরিয়া। ন্যায়নীতি, আদর্শ, ন্যায়বিচার, দেশপ্রেম, মানবতা রাজনীতিতে অবশিষ্ট নেই, তাই রাজনীতি পচে যেতে বসেছে। এ রাজনীতি থেকে প্রজন্ম কোন সুশিক্ষা পাচ্ছে না, তারা এ দেশের রাজনীতিকে ঘৃণা করছে এবং বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সুতরাং, অদূর ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যোগ্য উত্তরসূরির প্রকট অভাব দেখা দিতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.