দুর্নীতি ও রাজনীতি :: জিম্মি জনগণ? by ইফতেখারুজ্জামান

দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার অন্যতম অন্তরায়। দুর্নীতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে দুর্বল করে। দুর্নীতির ফলে মানুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দুর্নীতি আইনের শাসনের পরিপন্থী। দুর্নীতির ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সরকার ও মৌলিক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থার অবনতি হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারনা সূচকের ০-১০০ স্কেলে ২০১৩ এ বাংলাদেশ ২৭ পয়েন্ট পেয়েছে, যা বৈশ্বিক গড় ৪৩ এর তুলনায় অনেক কম। বিব্রতকরভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহের মধ্যে শুধুমাত্র আফগানিস্তান ছাড়া দ্বিতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্নীতির নেতিবাচক প্রভাব বেড়েই চলেছে। ডিসেম্বর ২০১২ তে প্রকাশিত টিআইবি পরিচালিত মানুষের অভিজ্ঞতাভিত্তিক জাতীয় খানা জরিপ ২০১২ এর তথ্য অনুযায়ী দেশের ৬৩.৭ শতাংশ মানুষ সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। সেবাগ্রহীতার নিকট থেকে আদায়কৃত ঘুষের মোট প্রাক্কলিত অর্থের পরিমান জাতীয় আয়ের ২.৪ ও জাতীয় বাজেটের ১৩.৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা ২০১০ এ যথক্রমে ১.৪ ও ৮.৭ শতাংশ ছিল।

স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত বিশেষায়িত নিরাপত্তা-বেষ্টনী কার্যক্রমেও অনিয়ম প্রকট আকার ধারন করেছে। সরকারী খাতে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বা অবৈধ অর্থ প্রদানের সামর্থ চাকুরীতে নিয়োগ প্রাপ্তির উপায়, মেধা বা যোগ্যতা আর তেমন কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে ২৪ এপ্রিল ২০১৩ রানা প্লাজা ধ্বসে ১২ শয়ের অধিক নিরাপরাধ শ্রমিক-কর্মীর নির্মম মৃত্যুর মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে যে দুর্নীতির কারনে মানুষকে প্রানও দিতে হয়। রানা প্লাজা ধ্বসের পেছনে দুর্নীতির প্রভাব ছিল দিবালোকের মত পরিস্কার। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ ক্ষমতাবানদের সাথে যোগসাজসের মাধ্যমে অবৈধভাবে দখলকৃত জমিতে অবৈধ প্রক্রিয়ায় আইন ও বিধিমালা অমান্য করে নির্মিত ভবনে অবৈধভাবে পরিচালিত পোষাক কারখানায় ঝুঁকি চিহ্নিত হওয়া স্বত্ত্বেও কাজে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করে তড়িৎ মুনাফার লোভে শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিটি স্তরে ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার।

ব্যাংক, বীমা, গনমাধ্যম সহ ব্যবসা বানিজ্যে লাইসেন্স-পারমিট ও সরকারী ক্রয় খাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রাধ্যান্য প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। রাজনীতির সাথে ব্যবসার যোগসূত্র উদ্বেগজনক ভাবে বৃদ্ধির কারনে ক্ষমতার অপব্যবহার অপ্রতিরোধ্য রয়ে গেছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে যাদের মূল পেশা ব্যবসা তাদের অনুপাত স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ১৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দশম সংসদে ৫৮ শতাংশে উন্নীত হওয়া যেমন উদ্বেগজনক, একই ভাবে হতাশাব্যাঞ্জক সংবিধান-পরিপন্থী অবস্থান নিয়ে জাতীয় বাজেটে কালো টাকা বৈধ করার অব্যাহত সুযোগ।

সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রার্থী রাজনীতিবিদদের পর্বতসম সম্পদ আহরনের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তার মাধ্যমে ক্ষমতার অবস্থানকে মুনাফা অর্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহারের প্রবনতার প্রতিফলন ঘটেছে। বৈধ আয়ের সাথে সম্ভাব্য অসামঞ্জস্যের এ চিত্র প্রকাশের কারনে সংক্ষুব্ধ ক্ষমতাধরদের একাংশ যেমন নির্বাচন কমিশনের উপর আবদার নিয়ে হাজির হন, তেমনিভাবে নির্বাচন কমিশনও এ তথ্য প্রকাশ বন্ধ করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার ঘোষনা দেয়, যদিও নাগরিক সমাজের দাবীর প্রেক্ষিতে সরে আসতে বাধ্য হয়। প্রভাবশালী মন্ত্রীগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে সম্পদ আহরনের এ প্রবনতাকে শুধু সমর্থনই করেননি, বরং বিষয়টিকে একটি সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার মত সাহসিকতাও দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দুনীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঢালাওভাবে এরূপ অস্বীকৃতির আত্মঘাতি প্রবনতাই বিশ্বব্যাংকের হাতে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পে দূনীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে একদিকে সরকারকে বিব্রত করতে ও অন্যদিকে দেশবাসীকে স্বল্পঋণে দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সর্ববৃহৎ প্রকল্প থেকে বঞ্চিত করতে। একই অস্বীকৃতির প্রবনতার কারনে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকসহ সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংকে অনিয়মের ক্ষেত্রে বা শেয়ার বাজার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্গের ক্ষেত্রে। ডেমু ট্রেন ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন চিহ্নিত অনিয়মের ক্ষেত্রেও সরকার কোন প্রকার দৃঢ়তা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে।

ক্ষমতার রাজনীতির মূল উপাদান যে দুর্নীতি তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ক্ষমতায় থাকার ফলে লাভবান হবার সুযোগ যেমন পর্বতসম, ক্ষমতায় না থাকলে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবার পাশাপাশি জেল-জুলুম সহ বহুবিধ হয়রানীর ঝুঁকিও ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা শুধু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকেই ব্যাহত করছে না, রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার ব্যাপকতর বিস্তার ঘটিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভবনাকে ধুলিস্যাৎ করার ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে।

৫ জানুয়ারীর নির্বাচন সংবিধানের মর্ম ও চেতনার সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচন ছিল নিতান্তই ক্ষমতাকেন্দ্রীক, এখানে নির্বাচনী ইশতেহার কোন ভূমিকা পালন করেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিকতার ইশতেহার ঘোষণার প্রেক্ষিতে বলা হয়েছিল জনগনের ম্যান্ডেট পাবার উদ্দেশ্যে এবার নির্বাচনী ইশতেহার ব্যবহৃত হয়নি। অর্থাৎ সরকারের নিজস্ব অবস্থান অনুযায়ী সরকার জনরায়ের সঙ্কটে, যা কাটিয়ে উঠে জনগনের আস্থা অর্জন যতদিন তারা ক্ষমতায় থাকবেন ততদিনের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ সাথে থাকবে। ক্ষমতার লড়াই এদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষকে আরো দেখতে হয়েছে - ৩ মার্চ ১৯৮৮, ১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৬, ২২ জানুয়ারী ২০০৭। এবারের পার্থক্যটা এই যে, সহিংসতা এক অভূতপূর্ব বিভীষিকাময় রূপ ধারণ করেছে। লগি-বৈঠার উত্তরে দা-কুড়াল, তার সাথে পেট্রোল বোমায়, রগ কেটে, কুপিয়ে হত্যা করে, বৃক্ষ নিধন এবং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর উপর আঘাত হেনে সাধারন মানুষের জীবন, জীবিকা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তিতে এক দিকে নির্বাচন চাপিয়ে দেয়া ও অন্যদিকে নির্বাচন প্রতিহত করার নামে যা ঘটেছে - তা ক্ষমতা-কেন্দ্রীক রাজনীতির এক নির্লজ্জ ও নৃশংস চিত্র বৈ আর কিছুই নয়। এর ফলে শুধুমাত্র সহিংস অগণতান্ত্রিক শক্তি, যারা বিভৎস নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত তারা ছাড়া আর কারোরই জয় হয়নি।

আস্থা অর্জনের প্রথম পদক্ষেপ হতে পারত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অংশগ্রহণমূলক একাদশ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট সময়াবদ্ধ রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে আলোচনার পথ সুগম করা। নির্বাচনের আগে থেকে বলা হয়েছিল যে ৫ জানুয়ারী নির্বাচনের পরই একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সাথে আলোচনার সুত্রপাত করা হবে, যদিও শপথ গ্রহণের পর সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা জানিয়ে দিচ্ছেন যে সরকার পুরো ৫ বছরই ক্ষমতায় থাকবে। আস্থা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এজেন্ডার কথা বলা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়ন, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ দমন, আইনের শাসন, সুশাসন, দুর্নীতি দমন ইত্যাদি - সবই দেশবাসীর প্রানের দাবী। আশার কথা, আগের আমলে যেসব মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মসহ গগনচূম্বী সম্পদাহরনের অভিযোগ ছিল তাদের অনেককেই নতুন মন্ত্রীসভায় রাখা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেছেন যে তাদের বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তিনি কাউকে ছাড় দেবেন না। তবে সরকারের বি-টিমের ভূমিকায় লিপ্ত দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও নির্বাচন কমিশনের মত প্রতিষ্ঠান বাস্তবে জনপ্রতিনিধিত্বের অবস্থানে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে, এরূপ আস্থা জনমনে নেই বললেই চলে।

একদিকে পুরাতন-নতুনের সংমিশ্রণ ও অন্যদিকে তথাকথিত বিরোধীদলের সাথে ক্ষমতার ভাগাভাগির এক অভিনব ও বিভ্রান্তিকর মন্ত্রীসভা - আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে, এরূপ ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাস্তব ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে এই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালঞ্জ মোকাবেলায় সরকার কতটুকু অনমনীয় থাকতে পারবে তার এক তাৎপর্যপূর্ন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর একজন বিশেষ দূত নিয়োগের মাধ্যমে। বিশেষ দূত হিসেবে তার ভূমিকা যা-ই হোক না কেন, নির্বাচনে তার দলের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে মঞ্চায়িত সিরিজ নাটকে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা যে দরকষাকষির অন্যতম উপাদান ছিল তা গোপন কিছু নয়। সুশাসনের পথে আরো চ্যালেঞ্জ তৈরী হয়েছে দশম সংসদকে কেন্দ্র করে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সংসদীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার পর মূলত বিরোধীদলের সংসদ বয়কটের কারনে সংসদ তার প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

নবম সংসদের মোট কার্যকালের প্রায় ৮২ শতাংশ তৎকালীন বিরোধীদল বর্জন করে রেকর্ড স্থাপন করে। নেতিবাচক রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের তুলনায় খারাপ রেকর্ড করার প্রতিযোগীতা এমনই আত্মঘাতী যে, এবারের সংসদকে রূপান্তরিত করা হয়েছে কার্যত বিরোধীদলহীন একচ্ছত্র ভূবনে। এবারের সংসদে থাকবে সরকারের আজ্ঞাবহ একধরনের ক্যাঙ্গারু বিরোধী দল; থাকবেনা কোন অর্থবহ সংসদীয় কমিটি; থাকবেনা কোন কার্যকর সংসদীয় বিতর্ক, থাকবেনা বাস্তব অর্থে কোন গঠনমূলক সমালোচনা। নামে বিরোধী দল হয়েও মন্ত্রীত্বের জন্য যে আকুতি- মিনতি, আবার যে ভাবে তার প্রশ্রয়, তা অভূতপূর্ব। একদিকে ম্যান্ডেটহীন সরকার, অন্যদিকে সরকারের আজ্ঞাবহ সংসদ - এরূপ অবস্থায় আইনের শাসন যে আকাশ কুসুম নয় তা প্রমান করা হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আইন শৃঙ্খলা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে আইনের রক্ষক হয়ে উঠতে পারে ভক্ষক। নিরপরাধ সাধারন মানুষ হতে পারে মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার বানিজ্য আর জামিন বানিজ্যের সহজ শিকার। রয়েছে নির্যাতন, বিচার-বর্হিভূত হত্যা, গুম, ক্রসফায়ারের ঘটনা বৃদ্ধির ঝুঁকি। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বিশেষ করে বাক স্বাধীনতার মত মৌলিক অধিকার বৃহত্তর ঝুঁকির সম্মূখীন হতে পারে। বিপরীতমূখী দুই পক্ষের উর্ধ্বে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতাকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা বৃদ্ধি পেতে পারে। সমালোচনা মাত্রই বিবেচিত হতে পারে শত্রুতা হিসেবে। বার্তাবাহককে স্তব্ধ করার ঝুঁকি প্রকটতর হতে পারে কপটাচারীদের স্তাবকতার কারনে। এরূপ সম্ভাবনা ভুল প্রমান করতে চাই সমালোচনা সইবার ও ভুলত্রুটি সংশোধনের সৎ সাহস, যা হতে পারে জনগণের আস্থা অর্জনের অন্যতম চাবিকাঠি। প্রতিপক্ষের তুলনায় আরো সহিংস, আরো নেতিবাচক, আরো অগণতান্ত্রিক, আরো স্বেচ্ছাচারী, আরো বিব্রতকর আচরনের এক অসুস্থ প্রতিযোগীতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে আমাদের রাজনীতি। যে কারনে গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা বিসর্জন দিয়ে জনগণকে জিম্মি করে অপার সম্ভাবনার এই দেশের উন্নয়ন, সমাজ পরিবর্তন ও আর্থ সামাজিক অগ্রযাত্রার সম্ভাবনাকে ধুলিস্যাৎ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরী হচ্ছে রাজনীতির ফ্র্যাঙ্কেনষ্টাইন। রাজনীতি করাভূত হচ্ছে একদিকে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের, অন্যদিকে উত্থান ঘটছে সন্ত্রাসী, সহিংস, উগ্র, ধর্মান্ধ শক্তির। যে কোন গণতন্ত্রকামী দেশে রাজনৈতিক চর্চা ও নেতৃত্বের জন্য বর্জনীয় উপাদানের তালিকা প্রণয়নের প্রতিযোগীতায় লিপ্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা।

সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতা-কেন্দ্রীক নির্বাচন, কিন্তু শুধু নির্বাচন সংকটের সমাধান দিতে পারবেনা। এজন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের লক্ষ্যে কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে ঐক্যমত্য অর্জন অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রর্বতন, একই সাথে না-ভোটের পূন:প্রর্বতন এবং নির্বাচনী জোটের রাজনীতি বন্ধ করা। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পূর্নবিন্যাস, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করতে হবে। দুই মেয়াদের বেশী এক ব্যাক্তি সরকার প্রধান হতে পারবেন না। দলীয় প্রধান হয়েও একই সাথে সরকার প্রধানের পদাসীন হবার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। সংসদ বর্জনের সংষ্কৃতি আইন করে বন্ধ করতে হবে, একইসাথে সংসদ সদস্যদের নৈতিক আচরণবিধি প্রনয়ণ ও কার্যকর করতে হবে। সংসদে বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনীসহ রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক চর্চা বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। হরতাল-অবরোধ সহ সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম ও আন্দোলনের আচরণবিধি প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ণ করতে হবে যেন এরূপ কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার অপসংস্কৃতির অবসান হয়। সর্বোপরি ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে যে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যে গগণচূম্বী সম্পদাহরণের সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করছে তা নির্মূল করতে হবে। প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের মত প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করতে হবে। তালিকা যত দীর্ঘই হোক, এবং আপাত দৃষ্টিতে যত অবাস্তবই মনে হোক না কেন, গণতন্ত্র ও জনস্বার্থে শুরু করতে হবে এখনই, কালক্ষেপনের সময় নেই।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সমাধান যে অসম্ভব নয়, এটা সকলেই জানে। এজন্য বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই বিদেশীদের পরামর্শ। দেশের যেকোন একজন সাধারন নাগরিকের দাবীই যথেষ্ট। আর তা হল - জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের প্রত্যাশাকে অন্য সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দিতে হবে।।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)

No comments

Powered by Blogger.