ক্ষতিকর ফরমালিন অপব্যবহারে শাস্তি যাবজ্জীবন- মন্ত্রিসভায় আইনের খসড়া

জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিনের অপব্যবহার করলে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আবার এই অপরাধের বিচার হবে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর অধীনে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এবং অপরাধ জামিনযোগ্য হবে না।

ফরমালিন অপব্যবহারের এই কঠিন শাস্তির বিধান রেখে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৪-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সচিবালয়ে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। এই আইনে লাইসেন্স ছাড়া ফরমালিনের উৎপাদন, আমদানি, পরিবহন, মজুত, বিক্রয় ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে যে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৪ ম​ন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তা একটি ভালো উদ্যোগ। তবে নিরাপদ খাদ্যের জন্য এই আইন যথেষ্ট নয়। খাদ্যে যেসব বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়, তার মধ্যে ফরমালিন মাত্র একটি। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ হলেও অন্য রাসায়নিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে খাদ্য থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েই যাবে।

মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের সভার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এখন জাতীয় সংসদে এটি পাস হলেই আইনে পরিণত হবে। সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে, সংসদের চলতি অধিবেশনেই বিলটি উপস্থাপন করা হতে পারে। প্রস্তাবিত আইনে ফরমালিন বলতে ফরমালিন, ফরমালডিহাইড, প্যারাফরমালডিহাইড এবং এর যেকোনো মাত্রার দ্রবণ এবং সরকার-নির্ধারিত ফরমালিন উৎপন্নকারী অন্য কোনো পদার্থকে বোঝাবে।

আইনটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ফরমালিন জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। খাদ্যদ্রব্যের সংরক্ষণ ও পচনরোধে ফরমালিন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই প্রাণঘাতী ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে এই আইন প্রণয়নের কাজ হাতে নেওয়া হয়।

সম্প্রতি মৌসুমি ফলে ফরমালিন নিয়ে জনমনে আতঙ্ক দেখা দেয়। বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবি​সিসিআই) সরকারের এই উদ্যোগ নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। গতকাল সংগঠনটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই আইনের বাস্তবায়ন ফরমালিনের ভয়াবহ ক্ষতি থেকে দেশ ও সমাজকে রক্ষা করতে পারে।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া এই আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় মোট ছয়টি অধ্যায় ও ৩৭টি ধারা রয়েছে। আইনে লাইসেন্স ছাড়া ফরমালিন আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুত, বিক্রয় ও ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ থাকবে। লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফরমালিন-সংক্রান্ত হিসাব সংরক্ষণ করবে এবং তা কর্তৃপক্ষকে দেখাতে বাধ্য থাকবে। প্রতি জেলা ও উপজেলায় ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করা হবে।

 অপরাধ ও দণ্ড: কোনো ব্যক্তি লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড হবে। তবে তা দুই বছরের নিচে হবে না বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে। আর লাইসেন্স নেই এমন কারও কাছে বা তাঁর দখলভুক্ত কোনো স্থানে ফরমালিন উৎপাদনের ব্যবহারযোগ্য কোনো যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম বা উপকরণ পাওয়া গেলে তা হবে অপরাধ। এ জন্য অনধিক ১০ বছর (দুই বছরে নিচে নয়) কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে (পাঁচ লাখের নিচে নয়)। আবার এ কাজের জন্য কেউ সজ্ঞানে তাঁর মালিকানাধীন বা দখলে থাকা কোনো বাড়িঘর, জায়গা-জমি, যানবাহন, যন্ত্রপাতি বা সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করতে অনুমতি দিলে অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হবে।

আবার কেউ কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা করলে শাস্তি হবে অনধিক চার বছরের কারাদণ্ড (এক বছরের নিচে নয়) বা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড।

বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ফরমা​লিনের বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত আগের মতোই চলবে। তবে তাঁদের যতটুকু ক্ষমতা আছে, ততটুকু প্রয়োগ করবেন এবং তা সঙ্গে সঙ্গে বিচারিক আদালতে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

 রাসায়নিক পরীক্ষাগার স্থাপন: আইন অনুযায়ী সরকার ফরমালিনের প্রকার, পরিমাণ, মাত্রা বা কোনো উপাদানের রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগার স্থাপন এবং এর জন্য রাসায়নিক পরীক্ষক নিয়োগ করা যাবে। আর পরীক্ষাগার স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত সরকার-নির্ধারিত যেকোনো পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা যাবে। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার বিধি করবে।

মন্ত্রিসভায় উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, খাদ্যে কোন মাত্রার ফরমালিন থাকবে, সেটি আইনে না থাকার কারণ জানতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তাঁকে বলা হয়, এটি বিধিতে উল্লেখ করা হবে।

আন্তর্জাতিক কলচার্জ কমানো উচিত: অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) বন্ধে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল টার্মিনেশন রেট কমানো যায় কি না, সেটি নিয়ে আলোচনা হয় সভায়। অ​নির্ধারিত আলোচনায় বিষয়টি তোলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তাঁর দাবি, এই রেট কমলে অবৈধ ভিওআইপির চাহিদা কমে যাবে এবং অবৈধ ব্যবসায়ীরা নিরুৎ​সাহিত হবেন।

বর্তমানে প্রতি আন্তর্জাতিক কলে তিন সেন্ট রাজস্ব পায় সরকার। এটাকে দেড় সেন্ট করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়।

সভার একটি সূত্র জানায়, ভিওআইপির প্রসঙ্গটি উঠলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কার ছেলে বা মেয়ের জামাই এর সঙ্গে জড়িত, সব তথ্য তাঁর কাছে আছে। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তিনি নিজেই নেবেন বলে উল্লেখ করেন।

বৈঠকে সমুদ্র গবেষণা বিল, ২০১৪ অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরও তিনটি আইনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.