জাতীয় ঐক্যচেতনার দৃঢ় ভিত্তি কোথায়? by ড. মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায় আর দাতা সংস্থাসমূহের ভূমিকা এখন ওপেন সিক্রেট। রাজনৈতিক বিষয়ের মতোই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তারা নীরব নয়। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রসহ সবাই বাংলাদেশের নানা আর্থ-রাজনৈতিক ইস্যুতে সরব। এদিকে বৈদেশিক সাহায্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হওয়ার কারণে দাতা সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতির হার কমিয়ে দিয়েছে। দেশের উন্নয়নে দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি নিম্নমুখী ধারাতেই রয়েছে। এর ফলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতি ও গভার্নেন্স ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য-পরিসংখ্যা মতে, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসে বৈদেশিক প্রতিশ্রুতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। মে মাস পর্যন্ত দাতা সংস্থাগুলো থেকে  প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৩৪৬ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার ডলার। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৫৫৬ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার। অর্থাৎ একই সময়ে প্রতিশ্রুতি কমেছে ২১০ কোটি ৪ লাখ ২০ হাজার ডলার। এসব তথ্যে সত্যতা সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কর্তৃকও পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, প্রতিশ্রুতি আদায়ের মধ্যে ঋণের পরিমাণ ২৯৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলার এবং অনুদান ৮১ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ এবং ৫৬ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার অনুদান ছিল। অপরদিকে একই সময়ে অর্থছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে। অর্থবছরের ১১ মাসে বৈদেশিক অর্থছাড় দাঁড়িয়েছে ২৬১ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২০৯ কোটি ৮০ লাখ ৮ হাজার ডলার। অর্থাৎ প্রায় ৫২ কোটি ডলার অর্থছাড় বেড়েছে। ইআরডি জানায়, অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে অনুদান ও ঋণ উভয়ই বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে অনুদান পাওয়া গেছে ৬৬ কোটি ২৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং ঋণ ১৯৬ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার। যা গত বছরের একই সময়ে অনুদান ছিল ৫৮ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার এবং ঋণ ১৭০ কোটি ৮৭ লাখ ডলার। মোটামুটিভাবে যারা খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের জানা আছে যে, দাতাদের মধ্যে বেশি অর্থছাড় করেছে বিশ্বব্যাংক। গত ১১ মাসে বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় করেছে ৮৯ কোটি ৯৮ লাখ ৯০ হাজার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৪২ কোটি ৩৪ লাখ ৯০ হাজার, জাপান ৩৩ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার ও চীন ৪৩ কোটি ১২ লাখ ১০ হাজার ডলার। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের হার কমেছে। এ সময়ে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১০২ কোটি ৮০ লাখ ১ হাজার ডলার। এর মধ্যে আসল ৮৪ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার এবং সুদ হচ্ছে ১৮ কোটি ৪৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ১১৩ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার ডলার। এর মধ্যে আসল ৮৪ কোটি ৭৭ লাখ ২০ হাজার এবং সুদ হচ্ছে ১৮ কোটি ৩৯ লাখ ৯০ হাজার ডলার। কেন দাতাদের সাহায্য প্রতিশ্রুতি কমে যাবে? এটা ঋণ ও সাহায্য-নির্ভর উন্নয়নশীল অর্থনীতির একটি দেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জও বটে। দাতাদের প্রতিশ্রুতি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে দায়ী করা হয়েছে, বৈদেশিক সাহায্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কম হওয়াকে। এ কারণে বৈদেশিক প্রতিশ্রুতির হার কমেছে। বৈদেশিক সাহায্যের  প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়াতে হবে, এটা অর্থনীতির মূল কথা। কিন্তু শাসনের মধ্যে নানা দুর্নীতি ও স্থবিরতা থাকলে এবং উন্নয়নের মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এসে ভর করলে, সেটা প্রায়ই সম্ভব হয় না। উন্নয়ন ও অর্থনীতি একটি দেশের মূল রক্তপ্রবাহের মতো। কিন্তু রাজনৈতিক মতভেদ, উত্তাপ, প্রশাসনিক স্থবিরতাসহ নানা দুর্বলতার কারণে কাঙিক্ষত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হয় না। কেবল বিদেশী শ্রমিকের পাঠানো মুদ্রা, পোশাক শিল্পের আয় ইত্যাদির দিকে তাকিয়ে না থেকে কৃষি ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প খাতকেও বেগবান করা দরকার আছে। দরকার আছে ক্রমে ক্রমে বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য ও কমিটমেন্ট। বাংলাদেশে যে  সে বিষয়টিই এখন সবচেয়ে দুর্লভ। ফলে বাজেটের ধাক্কা বা রোজার সময় যেমন অর্থনীতি মুখ থুবড়ে যায়, বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটে, তেমনিভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম-অবরোধ-হরতালের সময়ও একই ঋণাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাজনীতি মানুষের উদ্ধারের বদলে প্রতিপক্ষ নিধনের জন্য ব্যবহার ও প্রয়োগ করায় কুফল স্বরূপ স্বার্থান্বেষী মহল রাজনৈতিক ঘোলাজলে অর্থনীতিরও ক্ষতি করে এবং বাজার ও পণ্য পরিবহনে সঙ্কট তৈরি করে মজুতদারি ও মুনাফাখোরির মাধ্যমে তীব্র সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটায়। চাহিদা থাকায় ভেজাল ও বিষাক্ত পণ্যও মানুষ কিনতে বাধ্য হয়। ফলে পুরো বিষয়গুলোই কেবল রাজনীতি বা কেবল অর্থনীতির একক বিষয় নয়, শাসন বা গভার্নেন্স ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয়। বাংলাদেশে যে তলে তলে শাসন ব্যবস্থায় নানা ছিদ্র তৈরি হচ্ছে এবং তা দিয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর নানা প্রপঞ্চ বানের স্রোতের মতো ঢুকছে, সেটা বন্ধ না করলে পরিস্থিতির উন্নয়ন অসম্ভব। ঝগড়া আর পারস্পরিক লড়াইয়ে কিংবা ক্ষমতার দম্ভে কাজটি করা যাবে না। করতে হবে শুভ বুদ্ধিকে জাগ্রত করার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যচেতনার দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমরা কেউই বিশেষ করে, বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলো খণ্ডিত ও দলীয় মনোভঙ্গির কারণে নিজেরাই জানে না, শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যচেতনার দৃঢ় ভিত্তিটি আসলে কোথায়?

No comments

Powered by Blogger.