শুধু বক্তব্য প্রত্যাহার যথেষ্ট নয় by কাজল ঘোষ

শামীম ওসমানকে নিয়ে কথা বলতে গেলে একটু পিছন থেকে শুরু করতে হয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পবিত্র সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। তার ধারাবাহিকতায় দেরি হলেও সৈয়দ আশরাফ নেত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। এটা অবশ্য স্বাভাবিক। এতে চমকের কিছু নেই। আমাদের দেশে নেত্রীরা যা বলবেন তার বাইরে সেই দলের বাকিদের কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়। ভিন্নমত পোষণ করলে সংবিধানেও এসব দলছুটদের মতের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রাখা আছে। একই রকম দলেও একদম ভিন্নতা পোষণের বা লালনের সুযোগ নেই। এই দু’জনের পর আর দলের অন্যদের ভিন্নমতের সুযোগ থাকবে ভাবার কোনও অবকাশ নেই। কিছুদিন আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগের এক মাঝারি গোছের সাবেক ছাত্রনেতার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কুশলাদি বিনিময়ের পরপরই জানতে চাইলাম, পেশাগত কারণেই এটা জানার খুব ইচ্ছা, কি এমন হলো যে শামীম ওসমান যেখানে নানা কারণে বিতর্কিত সেই পারিবারের পাশে দাঁড়ানো বা পরিবার নিয়ে জাতির সামনে এ ভাবে বলার মতো ঘটনা ঘটলো। যখন নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো এত বড় চাঞ্চল্যকর খুন নিয়ে উত্তাল, ওই এলাকাসহ দেশের বিবেকবান মানুষের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে শামীম ওসমানকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের- সেখানে যদি আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ পরিবারের পক্ষে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে পক্ষ নেন, তাহলে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার সম্ভব কিভাবে? তাছাড়া প্রধান আসামি নূর হোসেনের পালিয়ে যাওয়ার অডিও নিয়ে তো নানা জল্পনা রয়েছে। আর ঘটনার পর থেকেই নানা প্রসঙ্গে ঘুরে ফিরে তার দিকেই তো অঙ্গুলির নির্দেশ। একেক দিন একেক কথা বলে তিনি বিভিন্নভাবে রহস্যের কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন, ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য ন্যায়বিচারের পথে বা সুষ্ঠু তদন্তের অন্তরায় কিনা। মাঝারি গোছের সংক্ষিপ্ত ও সরল উত্তর ছিল। ঐতিহাসিকভাবে এ পরিবারটির কাছে আওয়ামী লীগের ঋণ আছে। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী এ পরিবারের সঙ্গে বেঈমানি করতে পারেন না। তাছাড়া উনি (প্রধানমন্ত্রী) কত বড় মনের মানুষ হলে শত প্রতিকূলতাতেও এ পরিবারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। শামীম ওসমানের সাম্প্রতিক তিনটি কর্মকা- নতুন করে আলোচনায় এসেছে। একটিতে সাংবাদিক সমাজের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার আর অন্যটিতে সীমাহীন ক্ষমতার দাপট প্রকাশ। আলাপচারিতায় সাংবাদিকদের উদ্দেশে শামীম ওসমান নগ্নভাষায় যাচ্ছেতাই বলেছেন। অন্যদিকে ভাইয়ের নির্বাচনী এলাকায় ভোট বাগাতে নেতাদের অডিও ক্যাসেটে নির্দেশনা, দায়িত্বরত এএসপিকে দেখে নেয়ার হুমকি। সত্যি এমন সোনার নেতা নিয়ে আমাদের গৌরবের আছে। সংসদের কার্যবিবরণীতে ওসমান পরিবারের এ সোনার ছেলে নিয়েও আমাদের নেতা-নেত্রীদের প্রশংসাসূচক বাণী গ্রন্থিত হয়ে থাকবে। ইতিহাসের কাছে এরাই সফেদ। কি দুর্ভাগ্য আমাদের রাষ্ট্র এসব মানুষদের পাশেই দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগের শুরুর দিনগুলো, নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সময় এ পরিবারের সহায়তা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। এত অনাচারের পরও কৃতজ্ঞতা সত্যিই বিরল ঘটনা। কিন্তু অন্যায় আচরণ, দুর্বৃত্তায়ন, সন্ত্রাসী কর্মকা-, হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, বেপরোয়া প্রবৃত্তি, কাউকে কেয়ার না করা, অযথাই মানুষের চরিত্র হননে লিপ্ত হওয়া কোন মানুষ যে পরিবার বা সমাজের হোক- সব সময়ই ক্ষতিকর। নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি দেখলেই এটিই সহজেই অনুধাবন করা যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীকে বলি আপনি তো এ পরিবারের পাশে আছেন। দায়িত্ব নেয়ার কথাও বলেছেন। তাহলে শামীম ওসমানের এ বেপরোয়া আচরণের, দুর্বৃত্তপরায়ণ মনোভাবের বিচারের ভারও তো আপনার উপরই বর্তায়। সন্তানের ভাল কাজের গৌরব যেমন পিতা-মাতার সুনাম তেমনি খারাপ কাজের জন্য দায়টাও তাদেরই। দুঃখ হয়, প্রধানমন্ত্রী শামীম ওসমানকে ডেকে কেন বলেন না আর একটিও খারাপ ঘটনা নারায়ণগঞ্জে দেখতে চাই না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের মতো এক ক্ষুদ্র সাংবাদিকের জন্য এটি সত্যিই দিবাস্বপ্ন। এখানে জোর যার মুল্লুক তার। এখানে শক্তের ভক্ত নরমের যম। যারাই যখন নেতৃত্বে তারাই দুষ্টের দমন না করে উল্টোটাই করে। লালন-পালনেই তাদের ক্ষমতার সিদ্ধি। একটু ফিরে দেখলেই দেখা যাবে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এর আগেও একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গেয়ে মিডিয়াকেও দুষেছেন। তাদেরই একজন ফেনীর জয়নাল হাজারী। অন্যজন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন। শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম জমানায় মিডিয়াতে যখন জয়নাল হাজারীর নানা অপরাধ কার্যক্রম নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হচ্ছিল তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এই সব কিছুই বর্ষীয়ান কিছু আওয়ামী লীগ নেতাদের ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। দ্বিতীয় জমানায় আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে যখন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ দুর্নীতির অভিযোগ তুললো তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ওনাকে (আবুল হোসেনকে) সত্যিকার দেশপ্রেমিক বলে উল্লেখ করলেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবার নিয়ে বলেছেন, যেখানে অন্যদের বড় বড় অন্যায় নিয়ে কোন কথাই বলা হয় না, সেখানে তাদের পরিবারের ছোট ছোট ভুলকে সবসময় বিশাল করে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা ক্রেস্ট কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তাতে ছোটখাটো দুর্নীতি কোনও দুর্নীতিই নয়। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে, প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণকারের মায়ের স্বর্ণ চুরির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এ দুর্নীতিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ফিরি শামীম ওসমান প্রসঙ্গে। যে সাংবাদিক সমাজ ও দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া দেশের গণতন্ত্রহীনতা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, গডফাদারদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্রী ভাষায় অবলীলায় তিনি বলে গেছেন- যা রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের জন্য চরম অবমাননাকর। এর আগে সরকারদলীয় বেশ ক’জন সংসদ সদস্য বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করেছেন- যার কোন প্রতিকার হয়নি। শামীম ওসমানের বক্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই সম্পাদক পরিষদ, বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতৃবৃন্দ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তীব্র নিন্দা ও বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের কোনও মহল থেকেই এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। এখন এ ঔদ্ধত্যের তীব্র প্রতিবাদ সময়ের দাবি। শুধু বক্তব্য প্রত্যাহারই যথেষ্ট নয়, নোংরা ভাষায় কথা বলার জন্য সরকারদলীয় এ সংসদ সদস্যের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়াই হবে একমাত্র করণীয়।

No comments

Powered by Blogger.