স্ত্রীর দাবি, ১০ লাখ টাকা নিয়ে জাবেদকে হত্যা করেছে ডিবি by আল আমিন

‘প্রায় ২ বছর ধরে লাইনম্যানের টাকা উঠানোকে কেন্দ্র করে আমার স্বামীর সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক নেতা খাইরুল ইসলাম খায়ের, ব্লেড খোকন, ফালান, জাকির ও বাবুর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। আগে কয়েকবার হত্যার হুমকিও দিয়েছিল। আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা নিজ হাতে খুন না করে ডিবি পুলিশকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে।’ শনিবার গভীর রাতে মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ডিবি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত রমজান আলী জাবেদের স্ত্রী নূসরাত জাহান ঝর্ণা হত্যাকান্ড- সম্পর্কে এমন বক্তব্য দিয়েছেন গতকাল। সকালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক গ্রামের মদিনা টাওয়ারের ছয়তলা ফ্লাটে গিয়ে দেখা যায়, বাসায় প্রতিবেশীদের ভিড়। তারা জাবেদের নিহত হওয়ার ঘটনাটিকে ক্রসফায়ার বলতে নারাজ। বলেছেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড-। জানতে চাইলে নূসরাত জাহান ঝর্ণা জানান, সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল মালিক ও শ্রমিক সমিতিতে প্রায় পাঁচটি গ্রুপ রয়েছে। নিজের আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার করার কারণে প্রতিটি গ্রুপ নিজ নিজ উদ্যোগে পরিবহন শ্রমিক সমিতি গঠন করেছে। পাঁচটি গ্রুপের মধ্যে একটি ‘ঢাকা পরিবহন শ্রমিক কমিটি’। এর রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৪৯৪। এটির অস্থায়ী অফিস রাজধানীর মগবাজারের জয়কালী মন্দিরের বাম পাশে। ওই কমিটির প্রায় ৩ বছর ধরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন তার স্বামী জাবেদ। তিনি আরও বলেন, ঢাকা পরিবহন শ্রমিক কমিটির সভাপতি খাইরুল ইসলাম খায়ের। খাইরুলের আরও কয়েকজন সহযোগী আছে। তার সঙ্গে দ্বন্দের জের আমার জাবেদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। ওই কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন রুট ভাগ করে পরিবহন থেকে টাকা উঠাতো। ঝর্ণা জানান, তার স্বামী কাঁচপুর, দাউদকান্দি ও হোমনা রোডের প্রধান লাইনম্যান ছিল। তিনি প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা উঠাতেন। তিনি ওই টাকার কাউকে ভাগ দিতেন না। এ নিয়ে শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে খায়ের অভিযোগ করেন। খাইরুল ইসলাম খায়ের ও তার লোকজন ডিবিকে ১০ লাখ টাকা দিয়ে এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে। কিসের ভিত্তিতে এ অভিযোগ করা হচ্ছে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, ওই কমিটির কয়েকজন সদস্য আমাকে একথা জানিয়েছেন। আমরাও সব স্থানে সোর্সকে কাজে লাগাচ্ছি। স্বামীর শোক কাটিয়ে উঠে আমি আইনের আশ্রয় নিবো।

পুলিশের খাতায় জাবেদ একজন শীর্ষ ডাকাত এবং তার নামে অসংখ্য মামলা রয়েছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তার স্বামী থাকতেন কদমতলীর রায়েরবাগের দোতালা মসজিদের পাশের একটি বাসায়। ওই থানায় তার নামে কোন মামলা নেই। অথচ এখন বলা হচ্ছে রাজধানীর প্রায় থানায় জাবেদের নামে অনেকগুলো মামলা আছে। এ হত্যাকা-কে ধামা চাপা দেয়ার কারণে এসব কথা বলা হচ্ছে। তিনি রূপা ও কানিজকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। রূপা ও কানিজ নিহত জাবেদের স্ত্রী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তা আমার জানা নেই। শুধু জানি আমিই জাবেদের একমাত্র স্ত্রী। যোগাযোগ করা হলে ঢাকা পরিবহন শ্রমিক কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মোস্তফা কামাল জানান, নিহত জাবেদের আগের কমিটির নেতা ছিলেন তিনি। শ্যামপুর ধোলাইপাড়ের টুটুলের অফিসে প্রায় দু’মাস আগে খাইরুল ইসলাম খায়েরের সঙ্গে জাবেদের হাতাহাতি হয়। এ সময় খাইরুলকে জাবেদ একটি থাপ্পর মারেন। তখন খাইরুল বলেন, র‌্যাব, থানা ও ডিবি আমার। যত টাকা খরচ হবে হোক, কিন্তু তোকে যে কোন মুহূর্তে সাইজ করে দিবো। এসময় খাইরুল একটি মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান। আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি, খাইরুল ও তার লোকজন ডিবি পুলিশকে প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে এ খুন করিয়েছে।
তিনি আরও জানান, খায়ের ও তার লোকজন প্রকৃত শ্রমিক নেতা নন। তারা চাঁদাবাজ। শ্রমিক লীগের নাম ভাঙিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও তার আশপাশে পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি করে অবৈধ অর্থে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিছুদিন আগে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। তারা এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। তিনি তাদেরকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
এ ঘটনায় জড়িত থাকায় যার নাম শীর্ষ উঠে আসছে সেই খাইরুল ইসলাম খায়েরের সঙ্গে কথা হয় গুলিস্তানের গজারিয়া বাস কাউন্টারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি বলেন, জাবেদ একজন শীর্ষ ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজ। তাকে সবাই রমজান ডাকাত বলে চিনে। তার নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে। জাবেদ পরিবহন শ্রমিক নেতা বটে। কিন্তু, নেতার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে সে লাখ লাখ টাকার মালিক হয়েছে। তিনি দাবি করেন, জাবেদের সঙ্গে তার কোন দ্বন্দ্ব ছিল না। মতিঝিল এলাকায় ছিনতাই করতে গিয়ে সে ডিবি পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। জাবেদকে খুন করার জন্য রূপা নামে একজন মেয়েকে ব্যবহার করা হয়েছে জানালে তিনি বলেন, রূপা হচ্ছে জাবেদের তৃতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী ঝর্ণা, দ্বিতীয় স্ত্রী কানিজ। কানিজের সংসারে এক ছেলে সন্তান রয়েছে। জাবেদের কর্মকা- নিয়ে খোদ তার প্রথম স্ত্রী ঝর্ণাই বিরক্ত ছিল। এ ঘটনার সঙ্গে ঝর্ণায় জড়িত কিনা কে জানে! এ বিষয়ে কানিজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি রমজান আলী জাবেদের স্ত্রী। প্রায় দু’বছর আগে আমার সঙ্গে তার কোর্ট ম্যারেজ হয়। আমাদের সংসারে একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। কানিজ যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় থাকেন। অপরদিকে রূপার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি জাবেদ নামে কাউকে আমি চিনি না। প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, এ নম্বর পেলেন কোথায়। নিহত জাবেদের শ্বশুর জমি ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন জানান, খায়েরের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা জামাই জাভেদ কয়েক দিন আগে আমাকে জানায়। কয়েক দিন আগে খায়েরের সঙ্গে আমারও উত্তপ্ত ব্যাক্যবিনিময় হয়। খায়ের আমাকেও দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, আমার পরিবার এখন নিরাপত্তাহীনতায়। ঘটনার সময় আমি ঢাকায় ছিলাম না। তাবলীগ জামাতে নীলফামারী গিয়েছিলাম। আমার মেয়েকে তারা অল্প বয়সে বিধবা বানিয়েছে। সব তথ্য প্রমাণ নিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আমি সাংবাদিকদের খুনের ঘটনায় বিস্তারিত জানিয়ে খুনিদের মুখোশ উন্মোচন করবো।
কন্টাক্ট কিলিংয়ের কথা অস্বীকার পুলিশের: জাবেদ ও আকমলকে অর্থের বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ প্রত্যাখান করেছে পুলিশ। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে ফরমালিন বিরোধী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ কন্ট্যাক্ট কিলিং করে না। তারা (নিহতের পরিবার) তো এমন কথা বলবেই। কেননা তাদের সংসার চলে সন্ত্রাসীদের আয়ে। কমিশনার বলেন, সন্ত্রাসীরা গুলি করে ছিনতাই করবে আর পুলিশ বসে থাকবে- এটা হতে পারে না। সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষায় যা যা করণীয়, পুলিশ সবই করবে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের অর্থায়নে ফরমালিন বিরোধী প্রচারণায় ব্যাংকটির এমডি হাবিবুর রহমান ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মাসুম মিজান উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.