ঢাকায় সুষমা স্বরাজের দু’টি কাজ by সি. রাজা মোহন

ঢাকা পৌঁছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের দুই ধরনের কাজ থাকবে। একটি- ইউপিএ সরকারের শেষ বছরগুলোতে হারিয়ে যাওয়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি নতুন করে সচল করে তোলা। অপরটি- বাংলাদেশের সঙ্গে সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারিত্বের রূপরেখা উদঘাটন করা, যেন সেটা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রূপান্তরে নতুন সরকার যে লক্ষ্য নিয়েছে সে ক্ষেত্রে পরশপাথর হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত মাসে উপমহাদেশের সকল নেতাকে তার শপথ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণের মাধ্যমে দারুণ এক সূচনা করেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সহ আমন্ত্রিত সকল নেতা উপস্থিত হয়েছিলেন। এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের প্রতিবেশীরা দিল্লিতে একজন ফলপ্রসূ অংশীদারের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। মোদি একদিকে তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ভুটানকে বেছে নিয়েছেন আর এদিকে ঢাকার পথে সুষমা। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছে যে, মোদি তার পূর্বসূরির তুলনায় অধিক প্রত্যয়ী ও আলোচনায় আগ্রহী হবেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের কেমন সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত সে বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মনোভাব ছিল সঠিকই। কিন্তু তার নিজ দল থেকে পর্যাপ্ত সমর্থন ছিল না। আর তিনি কৌশলগত উদ্যোগ নিয়ে জনমতও সৃষ্টি করতে পারেননি। বাংলাদেশের সঙ্গে ইউপিএ সরকারের কর্মপ্রক্রিয়ায় কূটনৈতিক উচ্চাকাঙক্ষা আর রাজনৈতিক দুর্বলতার মধ্যে যে ব্যবধান ছিল তেমনটা আর অন্য কোথাও এত স্পষ্ট নয়। ২০১০ সালে মনমোহন সিং ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্দো-বাংলা সম্পর্ক নতুন করে গড়ে তোলার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস বিষয়ে ভারতের উদ্বেগে নজিরবিহীন নিরাপত্তা সহযোগিতার মাধ্যমে সাড়া দিয়েছে ঢাকা। ভারতে বাংলাদেশী রপ্তানিতে বেশির ভাগ শুল্ক বাধা সরিয়ে নিয়েছে দিল্লি। একত্রে তারা তিস্তা পানি বণ্টন ও দীর্ঘ দিনের সীমান্ত বিরোধ সমাধা করতে অন্তর্বর্তীকালীন একটি কাঠামো দাঁড় করেছিলেন। ২০১১’র সেপ্টেম্বর ঢাকায় যখন উদযাপনের উপলক্ষ হওয়ার কথা ছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাদ সাধলেন। তার বিরোধিতার মুখে তিস্তা পানিচুক্তি স্বাক্ষর করতে অনিচ্ছুক ছিলেন মনমোহন সিং। যদিও তিনি সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু সংসদে তা অনুমোদন করার ক্ষেত্রে তাকে বেগ পেতে হয়। ইউপিএ সরকার বাজেভাবে শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগকে হতাশ করেছে। তার পাশাপাশি দিল্লি যে বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার নয় ঢাকার, ঐতিহ্যগত এ সংশয় আরও জোরদার হয়েছে। তবে ঢাকার আশাবাদীরা বিশ্বাস করেন, মনমোহন সিং যা শুরু করেছিলেন তা শেষ করার সামর্থ্য মোদি সরকারের রয়েছে। সুষমা স্বরাজের সঙ্গে ঢাকায় যারা আলোচনায় বসবেন তারা জানতে চাইবেন, মোদি সরকার তাদের দেশের ভেতরের রাজনৈতিক শক্তিকে বাস্তবসম্মত নীতিতে রূপান্তর করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে প্রস্তুত কিনা। বিজেপির কিছু অংশ বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে বিরোধিতা করেছিল, ঢাকা সে বিষয়ে অজ্ঞাত নয়। এছাড়া তারা নির্বাচনী প্রচারণাকালে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান নিয়ে মোদির কড়া বক্তব্য নিয়েও উদ্বিগ্ন। শক্তিশালী একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব পূর্ব ভারত উপমহাদেশের সকলের জন্যই যে লাভজনক ফল বয়ে নিয়ে আসবে এমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেয়ার মাধ্যমে মোদি ও স্বরাজ ঢাকা ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোর উদ্বেগের উত্তর দিতে পারবে। সেখানে পৌঁছতে হলে দিল্লি ও ঢাকাকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, ভৌগোলিক অবস্থান তাদের নিয়তিকে অবিচ্ছেদ্যভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে। বাংলাদেশের জন্য ভারত বলতে গেলে তাদের একমাত্র প্রতিবেশী। দু’ দেশের মধ্যে সীমান্ত দৈর্ঘ্য ৪০০০ কিলোমিটার। ভারত বাদে শুধু মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। যা মাত্র ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ। ঢাকা যে নিজেকে ভারত পরিবেষ্টিত মনে করে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর দেশটির মূল ভূখ-ে বা বঙ্গোপসাগরে যেতে হলে সব থেকে সহজ হলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া। এই ভৌগোলিক আন্তঃনির্ভরশীলতা ব্যবস্থাপনা দীর্ঘ দিন ধরে দিল্লি ও ঢাকার জন্য প্রধান কৌশলগত চ্যালেঞ্জ। সামপ্রতিক সময়ে এসে উভয় পক্ষই অনুধাবন করতে পেরেছে যে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা থেকে শুরু করে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক আধুনিকায়নে প্রগতির জন্য তাদের একে অপরকে প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভারতে এ নিয়ে রাজনৈতিক সমর্থন অর্জনে তা সহায়ক হবে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকাগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বরাজকে অবশ্যই আলোচনা শুরু করতে হবে। বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও ভারত যদি এমন একটি পদক্ষেপের রূপরেখা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়, তাহলে উজানে থাকা চীনের সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যাবে। সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা গভীর করতে পারে দিল্লি ও ঢাকা। সীমান্ত চুক্তি চূড়ান্ত হলে, তা শুধুমাত্র দেশভাগের ফলে সৃষ্ট আঞ্চলিক জঞ্জালই সাফ হবে না বরং উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা উন্নয়নে সহায়ক হবে। স্বরাজ যদি বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত সফরের সময় পান, যেখান থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রায় অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে থাকে- তাহলে তিনি বুঝবেন ভারতের দিকে বাণিজ্য অবকাঠামো কতটা শোচনীয়। দিল্লিকে যদি বাণিজ্য সুবিধা সহজতর করার ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হয়, ঢাকাকে অবশ্যই নিজেদেরকে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যকার ট্রানজিট কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখা শুরু করতে হবে। আবার ঢাকাকে যদি নিজ ভূখ-ের ওপর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার উপকার শনাক্ত করতে হয়, দিল্লিকে অবশ্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী শিপিং এলাকায় রাস্তাঘাট, রেল ও পানিপথ আধুনিকায়নে অবদান রাখতে হবে। ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশে একটি রূপান্তরক্ষম অবকাঠামোগত প্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ তা হতে পারে পদ্মার ওপর ২য় সেতু। দিল্লি ও ঢাকার জন্য অর্থনৈতিক সমন্বয় যদি অবিচ্ছিন্ন লক্ষ্য হয়, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই ব্যবসায়ী ও সীমান্তে সফররত পর্যটকদের জন্য ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। আর অবৈধ অভিবাসী বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে, উভয় পক্ষকে উপমহাদেশে স্বাভাবিক শ্রম স্থানান্তর ব্যবস্থাপনা শিখতে হবে। এককভাবে এটাকে বন্ধ বা এর অস্তিত্ব অস্বীকার না করে বরং ওয়ার্ক পারমিটের মাধ্যমে এটা করতে হবে। সর্বোপরি, স্বরাজকে উপলব্ধি করতে হবে যে, পাকিস্তানের প্রতি দিল্লির এত বেশি মনোযোগ যে বাংলাদেশের সঙ্গে অপার সম্ভাবনার বিষয়টি তাদের দৃষ্টিগোচরই হয় নি। পাকিস্তান যদি একটি সমস্যা হয় এবং ভারতকে যদি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হয় সে ক্ষেত্রে উপমহাদেশের ভৌগোলিক-রাজনীতি রূপান্তরে বাংলাদেশ অসামান্য কৌশলগত সুবিধা দিতে পারে। ঢাকার সঙ্গে সমন্বিত একটি অংশীদারিত্ব হতে পারে সেই চাবি যা পাকিস্তানের সঙ্গে ফলপ্রসূ অংশীদারিত্বের দরজা খুলে দিতে পারে।
লেখক দিল্লির অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সম্মানীয় ফেলো। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ।

No comments

Powered by Blogger.