'ঢাকা শহরে টলটলে পানির লেক চাই' by মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

অভিনন্দন অভিবাদন বেগুনবাড়ী ও হাতিরঝিলের স্বচ্ছ জলরাশির হ্রদকে ঘিরে সৃজিত সড়ক, সেতু ও সুশোভিত পায়ে চলার পথসহ ঢাকা শহরের হৃদয়মাঝে নান্দনিক পরিবেশ রচনার শুভ সূচনাকে।
এই মহানগরের ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথার কঠিন জীবনযাপনের মাঝখানে এক চিলতে শান্তি ও সৌকর্যের সারথী হিসেবে নয়নাভিরাম দুটি সেতুসহ এই অপূর্ব অবকাঠামোটি নির্মাণ প্রয়াস প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ পর্বের তাৎপর্যবাহী তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনেই এই লেখা।
সবারই জানা যে টঙ্গী ডাইভারসন রোড ও প্রগতি সরণি (পান্থপথ থেকে এয়ারপোর্ট রোড ও সোনারগাঁও হোটেলের দক্ষিণ পাশের বেগুনবাড়ী খাল) এবং টঙ্গী ডাইভারশন রোড হয়ে রামপুরা ব্রিজের মধ্যবর্তী নিম্ন এলাকার (যা হাতিরঝিল নামে পরিচিত) মধ্যবর্তী নিম্ন এলাকা বহুদিন ধরে অবহেলা ও অপরিকল্পিত অবয়বে অপব্যবহৃত হয়ে আসছিল। রাজধানী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থ এই নিম্ন এলাকার উত্তর দিকে টঙ্গী শিল্প এলাকা, পূর্ব দিকে রামপুরা ব্রিজ এবং পশ্চিম দিকে টঙ্গী ডাইভারশন রোড। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এই নিম্ন এলাকার জন্য প্রাথমিক উন্নয়ন পরিকল্পনার যে খসড়া প্রতিবেদন পেশ করেছিল ২০০৩-০৪ সালের দিকে তাতে উল্লেখ করা হয় যে এই এলাকায় যেকোনো রকম মাটি ভরাটের কাজ ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর ক্ষতিকর এবং জলাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দেবে এবং এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। হাতিরঝিল এলাকার হাইড্রোলজিক্যাল বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয় যে ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার জন্য এই নিম্ন এলাকা অবশ্যই সংরক্ষিত রাখতে হবে। এ কারণে সে সময় সমীক্ষা দল টঙ্গী ডাইভারশন রোড এবং প্রগতি সরণি সংযোগের মাধ্যমে সারফেস রোডের পরিবর্তে অ্যালিভেটেড রোড নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল। অ্যালিভেটেড রোড যদিও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইতিবাচক সংযোজন হিসেবে পরিকীর্তিত হবে কিন্তু এ ব্যবস্থায় বেগুনবাড়ী খাল ও হাতিরঝিলের দৈন্যদশাকে আরো নাজুক অবস্থায় নিয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে পারে বিবেচনায় ওই পরিকল্পনা পরিত্যাগ করা হয়।
২০০৭ সালের ৫ এপ্রিল সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে খাল ও ঝিলের পরিবেশগত সার্বিক উন্নতি বিধানসহ ঘূর্ণায়মান সংযোগ সড়কসহ অবয়ব পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। একই তারিখে এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি সভার দিকনির্দেশনা অনুসরণে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ২৩ এপ্রিল ২০০৭ পুনর্গঠিত ডিপিপি পেশ করা হয়; কিন্তু পিইসি সভার নির্দেশনা মতো যথাযথভাবে ডিপিপি পুনর্গঠিত না হওয়ার কারণে ডিপিপির বিভিন্ন ঘাটতি ও অসামঞ্জস্যতা উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে তা ফেরত দেওয়া হয় ৬ মে ২০০৭ সালে। এই প্রকল্পের অন্যতম প্রধান অঙ্গ ও জটিলতম কর্মকাণ্ড হলো বেগুনবাড়ী খাল এবং হাতিরঝিলের জমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত কার্যাবলি। ঢাকা জেলা প্রশাসন ও রাজউকের মধ্যে জমির প্রকৃত মালিকানা ও বরাদ্দ প্রদান বিষয়ে দীর্ঘদিনের মতানৈক্য ছিল। ২৪ এপ্রিল ২০০৭ সালে জেলা প্রশাসক ঢাকার ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৩০০ একর জমি আনুমানিক ব্যয় প্রাক্কলন ১১৫১.৬৪ কোটি টাকার হিসাব পেশ করা হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশনে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে 'হাতিরঝিল এলাকা সমন্বিত উন্নয়ন (পান্থপথ-প্রগতি সরণি সংযোগ সড়কসহ)' শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি ১৬০২.০৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে পেশ করা হয়। যুক্তি তুলে ধরা হয়, ঢাকার গড় বৃষ্টিপাত হিসাব করে হাতিরঝিল এলাকার সংশ্লিষ্ট অববাহিকা এলাকায় (পানি প্রবাহ ও নিষ্কাশন এলাকা) ঝিলের পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ঢাকার প্রায় ৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে বিবেচ্য প্রকল্পটির আওতায় নির্মিত ঝিল অবদান রাখবে বলে বুয়েটের প্রাথমিক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ী খালের গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট করা হলে সে ক্ষেত্রে এর রক্ষাপ্রদুযায়ী করার সংস্থান আছে কি না এবং নিকটস্থ ভবন ও অন্যান্য স্ট্রাকচারগুলো এবং রামপুরা সেতু ও টঙ্গী ডাইভারশন সড়কের ওপর নির্মিত কালভার্ট/সেতুর ওপর এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব যাতে না পড়ে সে বিষয়ে বিবেচনায় এনে প্রকল্প চলাকালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রকল্পটি বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশন (বিআরটিসি) যাবতীয় ডিজাইন; রাজউক জমি অধিগ্রহণ, ভূমি খনন, ঝিলের তলার পলি অপসারণ, ঝিলের রক্ষাপ্রদকাজ হিসেবে আরসিসি প্রি-কাস্ট পাইলিং; এলজিইডি হাতিরঝিল ও বেগুনবাড়ী খালের উভয় তীরে ১১.০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ, ৩২০ মিটার সৌন্দর্য বর্ধনমূলক সেতু নির্মাণ, ২ মিটার প্রশস্ত ও ১১.০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফুটপাত নির্মাণ; পান্থপথ ক্রসিংয়ে ২৫০ মিটার দীর্ঘ ওভারপাস নির্মাণ; ২.৫০ মিটার প্রশস্ত ঝিলের সীমানা বরাবর ১৪.০০ কিলোমিটার ওয়াক-ওয়ে নির্মাণ ও ল্যান্ড স্কেপিং, গার্ডেনিং, পার্ক ও স্ট্রিট ফার্নিচার স্থাপন, বৃক্ষরোপণ এবং ঢাকা ওয়াসা স্টর্ম ওয়াটার স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণ, পাইপ ড্রেন নির্মাণ, প্রধান স্যুয়ারেজ লাইন নির্মাণ, গৃহস্থালি বাণিজ্যিক সংযোগ লাইন নির্মাণ, লিফট স্টেশন নির্মাণ (পানি নিষ্কাশনের জন্য); ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন, পানি সরবরাহ পাইপ লাইন নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এটি নির্মিত হয়েছে। মাইলস্টোনরূপী এই অবকাঠামোতে সর্বমোট ২৪৪.৭৪৭৪৬ একর জমি ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে রাজউক (১৩.০৯০১ একর), বাংলাদেশ রেলওয়ে (১৮.৮৫০৩ একর), ঢাকা ওয়াসা (১৪.৭৩১০ একর), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (২৩.০১৫৬), কোর্ট অব অ্যাওয়ার্ডস (৫৫.৪৬০০ একর), খাস জমি (৮.২৫৬৮ একর) এবং ব্যক্তিগত জমি (১১১.৩৪৩৪ একর)।
জুন ২০১০-এর মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় আড়াই বছরেরও বেশি সময় নিয়ে এটির নির্মাণ শেষ হলো, তবে ওয়াসার কিছু কাজ এখনো বাকি। এরই মধ্যে ২০১১ সালের ৪ অক্টোবর প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয় অতিরিক্ত ৪৯৭ কোটি ৭২ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১৯৭১.৩০ কোটি টাকায় সংশোধিত হয়।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের চেয়ারম্যান এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য

No comments

Powered by Blogger.